Recent Posts

বন্ধু এসো জলে ভাসি দুখ ভাসানোর সুখে



একটা প্রচলিত গল্প দিয়ে শুরু করি।
এক রাজা শিকার থেকে ফেরার পর ভাবলেন তার শিকারের দুঃসাহসিক কাহিনী লিপিবদ্ধ করে ফেলবেন। দায়িত্ব পড়ল রাজকবির ওপর। রাজকবি পরদিনই প্রায় হাজারখানেক পৃষ্ঠার একটা বই নিয়ে হাজির হলেন। সবাই অবাক! এত দ্রুত কী করে লেখা হল এত বড় কাহিনী! পরে দেখা গেল, সেই বইয়ের প্রথম লাইন, “রাজা ঘোড়া ছুটিয়ে শিকারে বের হলেন।“ তারপর সব পৃষ্ঠাজুড়ে লেখা, “ঘোড়া ছুটছে টগবগ টগবগ টগবগ…।“
সিগবাদকে নিয়ে লেখার কথা ভাবতেই আমার মনটা এতই খারাপ হয়ে গেছে, যে আর কিছু লিখতেই ইচ্ছে করছে না। সেই রাজার শিকারের কাহিনীর মত টগবগের জায়গায় যদি বারবার লিখে দিই, “কলেজ জীবনে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর নাম সিগবাদ…” সেটাই হবে আমার বলা সবথেকে সত্যি কথা। তবে শুধু যে এই কারণে মন খারাপ, সেকথাও সত্যি না। সিগবাদ এ জীবনে যত কাহিনী করেছে, তার শুধু চুম্বক অংশ লিখতেও আমার আঙুল ব্যথা হয়ে যাবে। কী করে এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে এত কথা লিখব, সে কথা ভেবেও আমার মন যারপরনাই বিক্ষিপ্ত!

আজ সিগবাদের জন্মদিন। এই নামটা এতই আনকমন, আমি কাউকে এই নাম শুরুর দিকে সঠিক করে বলতে শুনিনি। পরীক্ষার খাতা দেওয়ার দিন সিগবাদের নাম পড়ে কোন না কোন গণ্ডগোল নিশ্চয়ই লাগত।
সেই সিগবাদ, যে একজন অতি আবেগপ্রবণ মানুষ, বৃষ্টি দেখলেই তার দুহাত আপনা থেকেই প্রসারিত হয়ে রোমান্টিক একটা আবহ তৈরি করে ফেলে, ফুটবলের মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে– সব জায়গায় ফাউল করতে ওস্তাদ, যেকোন নিয়মবহির্ভূত কাজ করতে গেলেই কোন অলৌকিক শক্তির দ্বারা ধরা পড়ে যাওয়া তার জন্য দুধ-ভাত, কৌতুককে নতুন এক পর্যায়ে তুলে ফিজিক্যাল জোকস তার অভিনব সৃষ্টি! তার যে এরকম কত গুণ আছে তার ইয়ত্তা নেই।

ক্লাস সেভেনে ভর্তি হওয়ার কয়েকদিনের মাথায় একটা ইন্সপেকশনের ঘোষণা পাওয়া গেল। যথারীতি বিভিন্ন বিদঘুটে কাজকর্মের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে গেল। শো (প্রদর্শন!) করার মত অনেক জিনিসের নাম আমি শুনেছি, কিন্তু নিজের ব্যবহার্য আন্ডারওয়্যারও যে কাউকে দেখাতে হতে পারে, সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। ইন্সপেকশনের সময় কতিপয় অতি উৎসাহী শিক্ষক টর্চলাইট হাতে রঙবেরঙের ছোট ছোট জাঙ্গিয়া (!) সীজ করতে লাগলেন। আমরা ক্লাস সেভেন, আমাদের আন্ডারওয়্যার ছিল আমাদের নিষ্পাপ মনের মতই সাদা! তাই আমাদের আন্ডারওয়্যার সেইসব শিক্ষকদের লক্ষ্য ছিল না। আমার শিক্ষকদের আমি খুবই শ্রদ্ধা করি, কিন্তু মানুষ হিসেবে সবাইকে আমি সমান পছন্দ করি, তা বলবো না। এরকম একজন অপছন্দের শিক্ষক আমার ডায়েরি সীজ করে নিয়ে চলে গেলেন। শুধু তাই না, তিনি দাঁত কেলিয়ে অত্যন্ত বিশ্রীভাবে হাসতে হাসতে আমাকে প্রচণ্ড বিব্রতকর কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। ইন্সপেকশনের পর আমার রুমে আরেকটা ছেলে এসে বললো, “তোমারও ডায়েরি নিয়ে গেছে? আমারও একই অবস্থা!” এর কিছুক্ষণ পর আমি আবিষ্কার করলাম এই ছেলেটার সাথে আমি এমনভাবে কথা বলছি, যেন সে আমার কতদিনের পরিচিত! বিপদের বন্ধুই যে প্রকৃত বন্ধু, সে কথা পুরোপুরি সত্য। এভাবে সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশে দুজন সম্পূর্ন নতুন একটি বিপদে পড়ে বন্ধুত্বটা শুরু হল।

আমি শার্লক হোমসের রীতিমত পোকা ছিলাম। পরের টার্মে ভাইয়ার কাছ থেকে শার্লক হোমস শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র নিয়ে গেলাম। সিগবাদ আমার কাছ থেকে বইটি নিয়ে হারিয়ে ফেলল। আমি অত্যন্ত কাতর স্বরে বললাম, “বইটা ভাইয়ার, আমাকে খুঁজে দিতে হবে।“ পরের প্যারেন্টস ডে তে আমার হাতে চলে এল চকচকে শার্লক হোমসের পুরো রচনাসমগ্র। এ তো দারুণ ব্যাপার, শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র নিয়ে গেলাম, পেয়ে গেলাম পুরো রচনাসমগ্র! কিন্তু দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য, বইটা ফেরত পাওয়া গেল। অতঃপর আমাকে ধার করে শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্রে যেগুলো ছিল না, সেগুলো পড়তে হল।

ক্লাস সেভেনের আরেকটা ঘটনা মনে পড়ল। এটা আমার কাছে খুব উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নভেম্বর মাসে রংপুরে ভালই শীত পড়ে। কম্বলমুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছি। তখনকার কম্বলে অবশ্য প্রস্রাবের মত একটা বিশ্রী গন্ধ ছিল, তবু ঘুমটা মন্দ লাগছিল না। আর আমার ঘুম যথেষ্ট গাঢ় ছিল, এটা অনেকের জানার কথা। সেরকম একটা রাতে সিগবাদ প্রায় অসাধ্য সাধন করে ফেলল। আমাকে জাগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো টিটিরুমে। গিয়ে দেখি হুলুস্থুল ব্যাপার। একেকজন ছবি আঁকছে, ককশীট জোড়া লাগাচ্ছে, হক ভাই একেকটা ছবি আঁকছে, মনে হচ্ছে সারাজীবন তাকিয়ে থাকা যাবে! তখন সশস্ত্র বাহিনী দিবসে ইংরেজি দেয়াল পত্রিকা হতো। জানা গেল, ক্লাস সেভেন থেকে ক্যালিগ্রাফারের প্রতিভা খোঁজা হচ্ছে। পরীক্ষার্থী আমি আর
Tanoy
। আমি বোকাসোকা মানুষ, হাতের লেখাও খারাপ ছিল না। এদিকে আশহাব আর
Muznabil
অত্যন্ত ডজার প্রকৃতির, তারা ইচ্ছা করে লেখাটা বাজে করে ফেলল। আমি তো আর
Hamim
দের মত আগে থেকে জানি না দেয়ালিকায় কাজ করা মানে সারারাত জেগে থাকা! তারপর থেকে শুরু হল আমার লেখালিখির নির্ঘুম রজনীর ইতিহাস, দিনরাত লিখি, প্রেপে গিয়েও লাইন টেনে পাইলট নিয়ে কাটাছেঁড়া করি। আমার জীবনে আটটা (সম্ভবত) দেয়ালিকা আমি লিখেছি, সবই সিগবাদের কল্যাণ। সিগবাদ সে রাতে খুব সুন্দর করে একটি নির্মম কাজ করে ফেলেছিল। ভাইদের বলেছিল, মোহাইমিনের হাতের লেখা ভাল। এজন্য অবশ্য আমাকে পরে অনেকবার সরিও বলেছে। তবে প্রতি বছর দেয়াল পত্রিকার সময়টা আমার খুব ভাল লাগত, মানুষের যে এত প্রতিভা থাকতে পারে, আমার জানা ছিল না। পরে কারও বিষয়ে লিখতে গেলে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আশা রাখি।

ক্লাস সেভেনের শুরুতেই সিগবাদের অতি নিরীহ রুমমেটরা সিগবাদকে ‘গুণ্ডা’ নামে অভিহিত করে ফেলল। এই নামটি সম্ভবত আমাদের ব্যাচের সবথেকে দীর্ঘস্থায়ী টীজনাম। সবার টীজনাম প্রায় মাসে মাসেই বদলায়, কিন্তু সিগবাদ তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তার গুণ্ডামিটা এমনভাবে ধরে রাখল, এই নামটা বদলাবার আর ফুরসতই পেল না! আসলে সিগবাদের কাজকর্মগুলোকে আদৌ গুণ্ডামি বলা যাবে কিনা সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কথায় কথায় সবাইকে প্রচণ্ড শক্তিতে একটু গুঁতা দেওয়া, কথা বলার সময় অকারণে জোর দিয়ে “খুচখুচ” করে কথা বলা, মানুষ বিরক্ত হচ্ছে না বুঝেই তাকে আরও বিরক্ত করা – এসব কারণেই মূলত এই নাম তার ভাগ্যে জুটেছিল। নোভিসেস ড্রিলের সময় আমি সিগবাদের সামনে ছিলাম। একদিন অসুরের শক্তিতে চেক মেরে ঠ্যাং দিয়ে আমার হাতের আঙুলের চামড়া তুলে ফেলল। এসব ছোটখাট কারণেই সিগবাদ এই গুণ্ডামির খেতাবটা পেয়ে গেল!
গায়ে অনেক জোর থাকলেও তোর মত আর কাউকে আমি ডজ মারতে দেখি নি। প্রতিটা পিটির ফলইনে কষ্টপার্টি (এক্সকিউজ ফলইন!), কয়েকদিন পরপর হসপিটালে ঘুরতে যাওয়া তোর নৈমিত্তিক একটা ব্যাপার। আর নিজের কাজ তো মাঝে মাঝে শখ করেও মানুষ নিজে করে! তোর মধ্যে কি এই শখ-আহ্লাদও নাই? “দোস্ত, মশারি খুলে দে”, “বাইরে শার্ট আছে দিস তো”… এরকম আরও কত আবদার।

হাউজে এরই মধ্যে এক অদ্ভুত সংকট দেখা গেল। শুকাতে দেওয়া কাপড় প্রথমে গায়েব হয়ে যায়, পরে ভেজা হয়ে ফেরত আসে। একদিন সকালে পিটির সময় আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার শার্ট নিয়ে সিগবাদ হেলতে দুলতে ঘুম ঘুম চোখে রুমে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম ঘুমের ঘোরে ভুলে নিয়ে গেছে। বললাম, দোস্ত, ওটা আমার শার্ট। সিগবাদ অত্যন্ত ভাবলেশহীনভাবে আমাকে শার্টটা ফেরত দিয়ে পাশের শার্টটা অনায়াসে নিয়ে চলে গেল, কার শার্ট নিল দেখার প্রয়োজনও বোধ করল না! এই সংকটের কর্তাকে পাওয়া গেল, কিন্তু সংকট সমাধান হলো না। পরে জানা গেল, এর পেছনে শুধু সিগবাদের হাত ছিল না, আরও অনেকেই শার্ট, হাফপ্যান্ট, মোজা, এমনকি স্যান্ডো গেঞ্জি ভাড়া করার মত নিয়ে যায়, ব্যবহার শেষে ধুয়ে আবার ফেরত দিয়ে যায়! আমি এদের সততা দেখে সত্যি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

ক্লাস নাইনের শুরুতেই সিগবাদ একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন নিয়ে হাউজে ঢুকে গেল! ভাইয়ারা দূরের কথা, তার রুমমেট ছাড়া কেউ এ কথা জানে না। ক্লাস নাইনে নতুন সেভেন আসবে। আমরা নতুন বাথরুম পেয়েছি (নিজেদেরটা অবশ্য তখনও পাইনি, এটার ইতিহাস পরে কোনদিন বলব হয়ত। আজ জায়গা হচ্ছে না!), সেই খুশিতে আমি সঞ্চয়িতা নিয়ে বাথরুমের ডিভাইডারে কবিতা পড়তে চলে গিয়েছি (কবিগুরু, আমায় ক্ষমা করো!)। আমাদের অনেক গুণী ক্লাসমেটদের নেতৃত্বে ব্লকের রং তুলে ফেলা হচ্ছে, উদ্দেশ্য নতুন করে রং করা হবে। এমন উৎসবমুখর পরিবেশে হঠাৎ জানা গেল সেসময়কার জেপি জামান ভাই সবাইকে পঁচিশ নম্বর রুমে ডেকেছেন। আমি কবিগুরুর বই বাথরুমে ফেলে পঁচিশ নম্বর রুমে ছুটে গেলাম (কবিগুরু, আমায় আবার ক্ষমা করো!)। আমরা তখনো জানি না সিগবাদের ফোন ধরা পড়ে গেছে। জামান ভাই খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, “কার কাছে আনঅথোরাইজড কী আছে, ফল আউট!” দেখি সিগবাদ এগিয়ে গেল। আমি লুকডাউন অবস্থায় একটু উপরে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি। এহেন গুরুতর অবস্থায় আবার জামান ভাই হুঙ্কার ছাড়লেন, “আর কারও কাছে কিছু আছে?” এবার দেখি আশহাব এগিয়ে গেল। আমি আরও আকাশ থেকে পড়লাম, আশহাবও ফোন নিয়ে চলে এসেছে নাকি! জামান ভাইও মনে হয় আমার মতই ভাবছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কী আছে?” আশহাব খুব সুন্দর করে বললো, “ভাইয়া, রঙিন একটা আন্ডারওয়্যার!” এই ঘটনার পরে মুখ আর কিছু করে না। অতএব, বাকি কাজ জামান ভাইয়ের হাতে থাকা লকারস্টিক করল। এই ঘটনা আরও অনেকদূর পর্যন্ত গড়াল, তবে প্রতিদিনের ঘটনা প্রায় একই। সিগবাদ মার খেতে থাকল।

ক্লাস নাইনে উঠতে উঠতে সিগবাদ কোনকিছু করলেই সবাই অব্যর্থভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে ফেলল সিগবাদ ধরা খাবে। একবার হাউজ চেক হল। একেকজন মোবাইলফোন, চার্জার, সিগারেট ধরা খেল, সিগবাদের কাছে পাওয়া গেল ইয়া বড় এক স্ক্রু ড্রাইভার। পরে জানা গেল, মনসুর ভাই (কলেজের ইলেক্ট্রিশিয়ান) একবার রুমের ফ্যান ঠিক করতে এসে এই বস্তু ভুলে রেখে গিয়েছিলেন। সিগবাদও সেটা নিজের মনে হাউজস্টোরে ব্যাগে রেখে দিয়েছে। অতঃপর স্টাফ লঞ্জসহ সব জায়গায় সিগবাদের বিশালাকার স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে একটা রূপকথা রটে গেল!
সিগবাদের ধরা খাওয়ার আরেকটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জীবনে সিগবাদ যত গল্পের বই পড়ে শেষ করেছে, তার থেকে কয়েকগুণ শেষ করার আগেই ধরা পড়েছে বলে জানা যায়। কথিত আছে, সিগবাদের ধরা খাওয়া বই দিয়ে বায়োলজি ডিপার্টমেন্টে রীতিমত একটা পার্সোনাল লাইব্রেরি হয়ে গেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ‘হাফ গার্লফ্রেন্ড’ পড়তে গিয়ে ধরা খাওয়া। শক্তি স্যার ছিলেন প্রেপের দায়িত্বে। যেদিন তাঁর দায়িত্ব থাকে, সেদিন সহজে কেউ গল্পের বই পড়ে না। কিন্তু হাফ গার্লফ্রেন্ডের আর সামান্য বাকি ছিল সিগবাদের। এমন আবেগী একটা মানুষ এমন রোমান্টিক(!) একটা বই পড়তে গিয়ে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। হঠাৎ পাশের ডেস্কের
আরেফিন
জানালো স্যার আসছেন। সিগবাদ চোখ মুছতে মুছতে বইটা ডেস্কে রেখে সামনে রাখা বায়োলজি বই খুলে বসলো। এদিকে শক্তি স্যার দেখলেন, একটা ছেলে বায়োলজি বই পড়তে পড়তে কান্না শুরু করে দিয়েছে! তিনিও বায়োলজির শিক্ষক, কিছুক্ষণের জন্য তাঁর কাছে মনে হল, এই ছেলেটাই বায়োলজির আসল করুণরস ধরতে পেরেছে! কিন্তু পরক্ষণেই নিজের প্রকৃত রূপে আবির্ভূত হলেন তিনি। অতঃপর বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরিতে আরেকটি বই যোগ হল– হাফ গার্লফ্রেন্ড।

ক্লাস টেনে তুই যেভাবে আমার পাশে ছিলি, সেরকম কাউকে আমি পাইনি। এই প্রসঙ্গটা আসলেই আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।

আমার ডায়েরি সীজ হওয়ার পর থেকে আমি আর ডায়েরি লিখি নি। কিন্তু সিগবাদ দমে যাওয়ার পাত্র নয়। সে আরও ডায়েরি লেখা শুরু করলো। একসময় দেখা গেল, আমি বাদে সবাই সিগবাদের গোটা চারেক ডায়েরি পড়ে ফেলেছে, সেসব ডায়েরির আবার কত বাহারি নাম! ডায়েরি পড়ে সবাই যে সিগবাদকে খুব রোমান্টিক এবং দুঃখী মানুষ ভাবছে, এটা দেখে মনে হল সিগবাদও মনে মনে বেশ খুশি। কিন্তু বাস্তবতা সেরকম ছিল না। প্রেমেন্দ্র মিত্রর ঘনাদা কিংবা নারায়ণবাবুর টেনিদা পড়ে আমি যত হেসেছি, সিগবাদের রোমান্টিক প্রেমকাহিনী সেরকম কমেডির থেকেও বেশি মানুষকে হাসাতে থাকল। এরকম একটা ডায়েরি আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র কেউ উদ্ধার করেছিলেন এবং সেটা নিয়ে তাঁদের মধ্যেও রীতিমত হাসির রোল উঠে গেল!

সিগবাদ খুব ভাল ফুটবল খেলত। ক্লাস এইটে পড়ার সময় কম্পিটিশনে সিগবাদ একটা বাইসাইকেল কিক নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আমি ফুটবল খুব কম বুঝি। কিন্তু সিগবাদের খেলাটা আমি খুব পছন্দ করি। ডিফেন্ডার হিসেবে সিগবাদকে আমার কাছে এক নম্বর মনে হয়েছে। তারপরেও বিভিন্ন কম্পিটিশনে সে মাঝমাঠেও খেলেছে। এমনকি অনেক কঠিন সময়েও সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মাঝমাঠে তাকে না খেলানো হলে সে মাঠে নামবে না! যা হোক, সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের কলেজের অন্যতম ভাল একটা খেলোয়াড় হল সিগবাদ। তবে মাঠে ফাউল করা নিয়ে সিগবাদের বেশ একটা কুখ্যাতি ছিল। খেলার সময় কিচ্ছু তার মাথায় থাকত না, কাকে কখন ধাক্কা দিচ্ছে, কাকে ল্যাং মারছে, কোনদিকে খেয়াল নেই! আমাদের শেষ কম্পিটিশনে তোর পেনাল্টি থেকে গোল না হলে হয়ত আমাদের ট্রেডিশন কিংবা সব ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ডটা হতো না। একবার ফাউল করতে গিয়ে নিজেই চিৎপটাং হয়ে ফুটবল মাঠে এমন লাথি দেয়া শুরু করলি যে, আমরা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, পরমুহূর্তে রেফারির ফাউলের বাঁশি শুনে যে দৌড় দিলি! তারপর থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি খেলার মাঠে আর কাউকে বিশ্বাস করবো না।

সিগবাদ ফুটবলে একটা বিশেষ ধরণের শট প্রচলিত করে ফেলল, তার ভাষায় এর নাম বাঁক শট! সম্ভবত একে সাহেবি ভাষায় ব্যানানা কিক বলা হয়। দেখা গেল, সিগবাদ বাঁক শট নিয়ে সবাইকে ভীষণ অস্থির করে ফেলল। একদিন এক নম্বর গ্রাউন্ড থেকে মস্ক পার করে প্রায় এথলেটিক্স গ্রাউন্ডে বল পাঠিয়ে দিল! এক দিন এর হাত মচকায়, আরেকদিন একজনের পিঠ জ্বালিয়ে দেয়, কোন কোন দিন হয়ত পুরুষের ঝুলে থাকা গৌরবে আঘাত হানে! অবশ্য অণ্ডকোষের ব্যথা নিয়ে হাসাহাসির কিছু নেই, এটা যে পায়, সেই বোঝে।
ছেলেরা ফুটবল খুব পছন্দ করত, ফলস্বরূপ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লীগ শুরু হলো। কিন্তু ফুটবলের প্রতি যার এত অনুরাগ, তাকে দেখা গেল প্রতি লীগেই কোন না কোন গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলছে! অতি আবগী মন নিয়ে সামান্য কিছুতেই সিগবাদকে বলতে শোনা গেল, “আচ্ছা, লীগ বাতিল করা হোক।“ সহজ কথায় সিগবাদ “লীগবাদ” বলে চেঁচামেচি করতে থাকল। ফলে তার নামটা এবার সিগবাদ থেকে লীগবাদ হয়ে গেল!
শুধু ফটবল না, মাঠের সব খেলাই তোর নখদর্পণে ছিল। একবার আমাদের হাউজের হয়ে একমাত্র ক্রিকেটে মেডেল পেয়েছিলি, এথলেটিক্সেও বেশ ভাল করতি। ডিসিপ্লিনের দিক দিয়ে তুই
Zahin
এর সমতুল্য নাকি জাহিন তোর সমতুল্য এটা ভাববার বিষয়। ফলে প্রায় গেমসেই তোকে দেখা যেত ইডির ব্যাগ কাঁধে হাসাহাসি করতে!

বদনবই (ফেইসবুক!) নামক নীল সাদা জগতে তোর কর্মকাণ্ড বড়ই অদ্ভুত! তোর ফেইসবুকের নামের কয়েকটা নমুনা দেয়া যেতে পারে, “কৃষ্ণচুড়ার সন্ধানে পিপীলিকা”, “নিঃসঙ্গ ইলেকট্রনযুগল”, “ব্ল্যাক বালক” প্রভৃতি! বিভিন্ন মেয়েকে “ডু ইউ লাভ মি?” জাতীয় মেসেজ করা থেকে বিরত থাক। এখনো সময় আছে, ভাল হয়ে যা!
Apurba
র কাছে আবার তোর আমিন ভাইয়ের সাথে শার্টের ব্যবসার কাহিনী শুনলাম! এসব ছেড়ে ভাল হয়ে গেলেই দেখবি নিজেকে আর কুফা মনে হচ্ছে না!
সিগবাদ, জাহিনকে নিয়ে লেখার সময় আমি বলেছিলাম মৃত্যুর কয়েকদিন আগে মরণের দূত এসে যদি আমাকে বলে আমার জীবন থেকে শেষ কয়েকটা দিন আমি কাউকে দিয়ে যেতে চাই কিনা, সেখানে আমি তোর জন্য একদিন বরাদ্দ রাখব। এই কথাটা হয়ত সত্যি না, সম্ভবত আমি তোর জন্য দুইদিন বরাদ্দ রাখব। আমি ক্লাস সেভেনে তোর কাছে ম্যাজিক স্কয়ার মেলানো শিখেছিলাম, এসএসসির সময় তোর কাছে রুবিকস কিউব শিখেছি। কিন্তু তোর কাছে আমি যে জিনিসটা সবথেকে ভালভাবে শিখেছি, সেটা হল বন্ধুত্ব। এই অদ্ভূত সুন্দর জিনিসটা শেখানোর জন্য তোর কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
তোর মত ভাল ছাত্র আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। তবে ইলেভেনে যখন পড়াশোনাটা পুরোপুরি ছেড়ে দিলি, তখন ভাবলাম এই ছেলেটা কী করবে! তারপর যখন দেখলাম একটা ছেলে এত কম সময়ে কণিকের মত একটা জটিল চ্যাপ্টার সরলরেখা না জেনেই শিখে ফেলল তখন বুঝলাম, এই ছেলে একদম ঠিক লাইনে আছে। যখন অনেক ভাল ছাত্রই কেতাব স্যারের পরীক্ষায় কণিকের অঙ্ক পারে নি, কিন্তু তুই পুরো পরীক্ষায় শুধু কণিকের প্রশ্নটাতেই ফুল মার্কস পেয়েছিস (অবশ্য বাকিগুলোতে এত খারাপ করেছিস, যে পাশ নিয়ে টানাটানি!), সেটা দেখে আমার মনে হয়েছে, আমি যদি শুনতাম রাগিবের জায়গায় তুই মেডিকেলে ফার্স্ট হয়ে গেছিস, আমি অবাক হতাম না।

সিগবাদ, ভাল থাকবি। সবকিছুর ঋণ মানুষ চাইলেও শোধ করতে পারে না, সেই দুর্বহ বোঝা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। আমাকে ভুলে যাবি না। আমি তোকে ভুলে গেলে মনে করিয়ে দিবি! আমার এই ছোট্ট জীবনে তোর মত নিঃস্বার্থ বন্ধু আমি আর পাই নি, ভবিষ্যতে পাব, সে আশাও কম।

কৃষ্ণকলির একটা গান দিয়ে শেষ করি –

“বন্ধু এসো স্বপ্ন আঁকি চারটা দেয়াল জুড়ে
বন্ধু এসো আকাশ দেখি পুরোটা চোখ খুলে
বন্ধু এসো জলে ভাসি দুখ ভাসানোর সুখে।“


শুভ জন্মদিন, সিগবাদ।
React

Share with your friends!


Comments