Recent Posts

একজন এল-টাইপ মানুষের গল্প


ক্যাডেট কলেজে আমার প্রথম রুমমেট নাফিস আর ফিরদৌস। রুমলীডার শাহনূর ভাই। দ্বিতীয় দিন আমাদের আইনস্টাইনের মতো দেখতে একজন লোকের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তিনি পরম আগ্রহে আমাদের চুল কাটতে লাগলেন। কাটতে কাটতে যখন আমাদের চুল কাটা শেষ হয়ে যেত, অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তিনি আমাদের পাঠিয়ে দিতেন, যেন মাথার চুল শেষ হয়ে যাওয়ায় আমরা একটা বিরাট অন্যায় করে ফেলেছি!

চুল কাটা শেষে অনেক খুঁজে বাথরুম বের করে গেলাম গোসল করতে। ফিরে এসে দেখি নাফিস খুব হাসাহাসি করছে, আর ফিরদৌস বোকার মত তাকিয়ে আছে। আমি পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। নাফিস বললো, "ফিরদৌস সেক্স মানে জানে না।" (ভাষাটা সম্ভবত অন্যরকম ছিল, মূলভাবটা এটাই!)

আমরা তখন উঠতি কৈশোরে। এসব বিষয় খুব বুঝি তাও না, আবার বুঝি না সেরকমও নয়। কিন্ত এসব শুনলে কেমন একটা উৎসাহ বোধ করি। সুতরাং আমি আর নাফিস পুরোদমে ফিরদৌসের জন্য যৌনশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করলাম। একটা শিশু কী করে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়, তার সম্পূর্ণ বর্ণনা নাফিস দিতে থাকলো। নাফিসের সরস গল্প শুনে মনে হয় সব বুঝি চোখের সামনে ঘটে চলেছে! আমি ফিকফিক করে হাসি, আর অবিশ্বাসের চোখে তাকায় ফিরদৌস।

এসময় এইটের দুয়েকজন আমাদের রুমে মাঝে মাঝেই আসতেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আসলেই এসব লাস্যময় গল্প শুরু করে দিতেন। এদের মধ্যে বর্তমানে চীনপ্রবাসী নাফি ভাই অগগ্রণ্য ছিলেন! ভাই এরকম কিছু জিজ্ঞেস করলেই আমি লাজুক হাসি দিতাম। নাফিস প্রচণ্ড আগ্রহ বোধ করা সত্ত্বেও কিছু বলত না। আর ফিরদৌস চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতো।

ঠিক কীভাবে এটা মনে নেই, তবে কিছুদিন পরে জানা গেল, ফিরদৌস আসলে সবই জানতো। কিন্তু আমাদের সাথে এমন একটা ভাব করতো, যেন কিছুই জানে না! ফিরদৌসের আগের স্কুলের বন্ধুদের কাছে জানা গেল, এসব বিষয়ে ফিরদৌসের সমান জ্ঞান আর কারও নেই। এভাবে ক্যাডেট জীবনের একদম শুরুতে দিনাজপুরনিবাসী এক বাটপারের কাছে সরল মনের আমি এবং ততোধিক নিষ্পাপ নাফিস একসাথে বোকা বনে গেলাম!

সেই নিষ্পাপ নাফিসকে নিয়ে লিখতে বসে মনে হল, জীবননদীর রহস্য বোঝা বড় মুশকিল। সেই নদীর মৃদু স্রোতে ভাসতে ভাসতে নিষ্পাপ নাফিস কী করে যৌবনের উদ্দাম স্রোতে 'এল-টাইপ' নাফিস হয়ে গেল - সবই তো চোখের সামনে দেখা!


ক্যাডেট কলেজের প্রথম মার খাওয়ার পর অনুভূতিটা ছিল এরকম, "শাহনূর ভাই আমাকে মারতে পারলো!" আমি ভাইয়ের কাছে বেনামে চিরকুট দিলাম, "ভাই, আপনার প্রতিটা মারের জন্য আমার অন্তরে একেকটা সাদা দাগ পড়ে গেলো!" কিন্তু নাফিস একটা অসাধারণ কাজ করে ফেললো। লোকনাথ স্যারের কাছে গিয়ে সুন্দর করে বলে দিলো, হাসিন ভাই তাকে থাপ্পড় দিয়েছে। ব্যস, নাফিস হয়ে গেল আমাদের রিপোর্টার!

আমরা যে মার খাচ্ছি, এই বিষয়টা স্যারদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নাফিস অভিনব সব পদ্ধতি বের করতে থাকলো। নাফিসের একটা নোটবুকে সম্ভবত এগুলোর জন্ম হতো। আমাদের প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখতে হতো। সেসব চিঠি আবার স্যারেরা পড়ে দেখতেন। নাফিস ভাবলো, এখানে লিখে দিলেও স্যারদের কাছে পৌঁছে যাবে। একদিন লাঞ্চের পর জানা গেল, ফর্মের কমপ্লেইন বক্সে নাফিস লিখেছে, বেল্ট দিয়ে মারা কি বৈধ? এরকম বিভিন্ন পদ্ধতিতে নাফিস আমাদের মজলুম জনতার পাশে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু দুঃখের বিষয় নাফিসের প্রতিটা পদক্ষেপই মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে থাকলো! 

একটা সুস্থ সবল মানুষ হয়ে নাফিস কলেজে প্রবেশ করেছিল। আস্তে আস্তে সেই নাফিসের মাথা বেঁকে যেতে থাকলো। অনেকটা স্টিফেন হকিং সাহেবের মতো। সেখান থেকে নাফিসের নাম হয়ে গেল 'কল্লা বাঁকা নাফিস'। বিষয়টা এমন ড্রিলের সময় 'ডানে সাজ', কিংবা 'ডানে দেখ' করালে নাফিসের আলাদা করে মাথা ঘুরাতে হয় না। আগে থেকেই কাত করা থাকে, সময়মতো একটা মোচড় দিলেই হয়!

ক্লাস এইটে নাফিসের মাথায় নতুন ভূত চাপলো। কম খরচ করার ভূত। সবকিছু জমিয়ে রাখার ভূত। এক টার্মে ড্রাই কেক এনে, পুরো টার্ম সেটার প্যাকেট না খুলে পরের টার্মে সেটার অর্ধেক খেয়ে বাকি অর্ধেক তারও পরের টার্মে খাওয়ার রেকর্ড নাফিসকে করতে দেখেছি। একটা ঝালমুড়ির প্যাকেট একদিন কিনে, এক সপ্তাহ পরে অর্ধেক খেয়ে প্যাকেটের খোলা জায়গাটায় শক্ত করে কাপড় নাড়ার ক্লিপ দিয়ে বন্ধ করে পরের সপ্তাহের জন্য জমিয়ে রাখার যে ব্যাপারটা, এমন আর কোথাও দেখি নি!

নাফিস এমনিতে জিনিসপত্রের অপচয় না করলেও একটা খাবারের প্যাকেট খুললে সবাইকে দিত। দেখা যেত, যেদিন নাফিস ক্যান্টিনে গেল, তার পর থেকে নাফিসের রুমমেটরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো, কবে এই প্যাকেটটা খোলা হবে! কুপন দেওয়ার সপ্তাখানেকের মধ্যে বেশিরভাগের কুপন শেষ হয়ে যেত। এদের সবার মুশকিল আসান ছিল নাফিস। সবসময় নাফিসের কাছে কোন না কোন খাবার থাকতোই। যে কারও ক্ষুধা লাগলে নাফিসের কাছে চলে যেত। নাফিসের গোপন ভল্টে সবার জন্য খাবারের বরাদ্দ থাকতো।

বাঁ থেকে - ইফাজ, আমি, নাফিস (ফোন হাতে), ফিরদৌস

এই "ভালো-কিন্তু-কৃপণ" নাফিসের মাথায় এবার নতুন ভূত চাপলো। কোন একবার নাফিসের পুরো পরিবার হজ্জ্বে গেল।  কলেজে থাকায় নাফিসের যাওয়া হলো না। কিন্তু নাফিস খুশি হলো। সেই ছুটিতে পুরো বাড়িতে নাফিস একা। তারপর থেকে নাফিস প্রচণ্ড পর্নপ্রেমিক হয়ে গেল। কম্পিউটার ল্যাবে কিংবা ফর্মে নতুন কোন পর্নের সাপ্লাই আসলে দেখা গেল, নাফিসের কমন পড়ে গেছে! এরপর কি হবে সব নাফিসের মুখস্থ! এর সাথে সাথে হস্তশিল্পের ব্যাপারেও নাফিস বেশ উৎসুক হয়ে গেল। 

নাফিসের আরেকটা বিষয় ছিল উচ্চারণে সমস্যা। যেমন, কোন কারণে নাফিসের একটা চকের দরকার পড়লো। তাজওয়ার নামের একটা জুনিয়রের কাছে নাফিস গেল চক চাইতে। নাফিস বলবে, "এই তাজ-ওয়ার, একটা সক দাও তো!" মানে তালব্য ধ্বনির উচ্চারণে সমস্যা। এই সমস্যার কারণ হিসেবে বরাবর নাফিস দাঁতের দোষ দিয়ে থাকলেও দীর্ঘদিন দাঁত সোজা করার ব্রেস পরার পরেও এই সমস্যার সমাধান হয় নি!

ক্লাস নাইনে দেখা গেল কেবল দুইজন মানুষ একদম শেষের দিকের কোণার বাথরুমটা ব্যবহার করে। সেখান থেকে তাদের দুজনের জন্য "শেষ বাথরুমে শেষ প্রহর" নামে একটা রগরগে প্রেমকাহিনী রচনা হয়ে গেলো! সেখানকার নায়ক ছিল নাফিস! সম্ভবত ইফাজ এইট-নাইনের দিকে নাফিসকে নিয়ে একটা অমর কবিতা রচনা করে ফেললো, "নাফিস হলো সেক্সি, পরে কালা মেক্সি, চালায় সে ট্যাক্সি, খায় ভরা ভরা ডেকচি।" এই কবিতাটার অন্য লাইনের কোন তাৎপর্য না থাকলেও কালা 'কালা মেক্সির' যে ব্যবহার, তার একটা গূঢ় অর্থ আছে! 

ক্লাস টুয়েলভে সেমিকন্ডাক্টরের চ্যাপ্টার পড়াতে এসেছেন এক স্যার। স্যার পড়াচ্ছেন, "এই! ইলেক্ট্রনের অভাবে সেমিকন্ডাক্টরে হোলের সৃষ্টি হয়।" নাফিস কী বুঝলো জানি না, চট করে জোরেসোরেই বলে ফেললো, "স্যার, হোলের সাইজ কতো?" স্যারও আবার কী বুঝলেন, জানি না, বললেন, "এই বেয়াদব ছেলেরা, কী বলছো! কে বললো এটা।" ঘটনার সময় আমি ক্লাসে উপস্থিত ছিলাম না, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দোজা স্যার, "এই, কে বললো!" বলছেন, বিষয়টা ভাবতেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছে! ক্লাসের মধ্যে এরকম একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে নাফিস প্রায়ই পড়ে যেতো। জনৈকা ইংরেজি ম্যাডামের ক্লাসে সবার চুপ করে যাওয়ার পর নাফিসের 'শশশ' শব্দের কথা মনে পড়লেও এখনো হাসি পায়! 

আমরা তিনজন (বাঁ থেকে - আমি, ফিরদৌস, নাফিস)

ক্লাস টুয়েলভে আমরা সেভেনের তিনজন আবার ১৩৫ নম্বর রুমে একত্র হলাম। 

যারা কমপক্ষে একদিনও নাফিসের সাথে কথা বলেছে, আমার ধারণা তাদের সবাইকেই নাফিস "এল-টাইপ" কথাটি বলেছে! এই এল-টাইপের রহস্য উদ্ধার করি।
কোনো এক রৌদ্রোজ্জ্বল রেস্ট আওয়ারে ঘুমানোর আগে আমার কেন জানি মনে হলো 'লেশ্যা' নামে বাংলায় একটা গালি কোথাও শুনেছি। আমার পাশের বেড নাফিস। কী মনে করে নাফিসকে জিজ্ঞেস করলাম, এই শব্দটা আদৌ গালি কিনা, কিংবা নাফিস কখনো শুনেছে কিনা। 

আমি জীবনে অনেক ভুল কাজ করেছি। কিন্তু এত বড় ভুল আর জীবনে করি নি! নাফিস একটা শব্দ শিখে গেল - লেশ্যা। হাঁটতে-বসতে-ঘুমাতে-ইউরিনালে-কমোডে-ফর্মে এমন কোন জায়গা নাই, যেখানে যেকোন কিছু হলেই নাফিস এই শব্দটা ব্যবহার করে না! দেখা গেল, সকালে পিটিতে লেট হয়ে যাওয়ায় জরুরি ভিত্তিতে নাফিসকে ডাকা হচ্ছে, হঠাৎ ঘুম-ঘুম চোখে নাফিস উঠে বলবে লেশ্যা। খুব গুরুগম্ভীর কিছু পড়ানো হচ্ছে ক্লাসে। হঠাৎ করে নাফিস বলে উঠবে লেশ্যা। কোন কারণ নাই, হঠাৎ করে নাফিস বলে উঠবে লেশ্যা।

অতি শীঘ্রই এই লেশ্যা আতঙ্কে সবাই অস্থির হয়ে গেল। সুতরাং নাফিসের লেশ্যা বলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। নাফিস এবার আর পুরোটা বলে না, কেবল 'লে' বলে থেমে যায়। এভাবে আস্তে আস্তে হয়ে গেল 'এল-টাইপ'। কিছুই না, হঠাৎ করে নাফিস বলে উঠবে 'এল-টাইপ'। 

এল-টাইপের পর যে কথাটা নাফিস সবচেয়ে বেশি বলতো, সেটা হলো, স্ট্রাইক রেট। স্ট্রাইক রেট ১০০% মানে হলো একদিনে একবার। কি কয়বার সেটা আমি বলবো না! নাফিস একটা খাতা বানালো, যেখানে পুরো হাউজের সবার স্ট্রাইক রেট থাকবে। সপ্তাহ শেষে সেখানে বিভিন্ন গ্রাফ এঁকে সবার সাথে তুলনা করে বুঝতে চেষ্টা করবে আসলে তার স্ট্রাইক রেট সবার থেকে অস্বাভাবিকভাবে বেশি কিনা। 

পরে দেখা গেল, অন্য একজনের সাথে নাফিসের স্ট্রাইক রেটের একটা মিল আছে। সুতরাং এরা দুজনেই এই অন্ধকার জগত থেকে পরিত্রাণের আশায় নিজেদের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ হলো। এক সপ্তাহে যার স্ট্রাইক রেট বেশি হবে, সে অন্যজনকে আইসক্রিম খাওয়াবে। মাঝে মাঝে আবার এই চুক্তিতে একটা ব্রেক দেওয়া হতো। তখন যে যার ইচ্ছেমতো স্ট্রাইক রেট বাড়িয়ে ফেলতো। মানে সুপার-ওভার খেলার মতো একটা ব্যাপার।

কোন একদিন যদি স্ট্রাইক রেটের দৌড়ে সেই অন্য বান্দা এগিয়ে যেত, অমনি নাফিসকে দেখতাম সেখানে সমতা ফেরানোর জন্য দৌড়াতে। নাফিসের থিওরিটা ছিল, "ছকবার আমার লাগবে না, আমার না দেওয়া লাগলেই হলো।" 


এক ছুটির পর নাফিস কোন এয়ার হোস্টেসের নীল ছবি দেখে সিদ্ধান্ত হলো এয়ার ফোর্সে এপ্লাই করবে। আমি ফর্ম তুললাম নেভিতে, ফিরদৌস আর্মিতে। মানে বিষয়টা এমন, কয়েকদিন পরেই গোটা বাংলাদেশের দায়িত্ব চলে আসবে ১৩৫ নম্বর রুমের হাতে, তিনজন তিন বাহিনীর প্রধান! যথাসময়ে আইএসএসবি শুরু হলো। নাফিস স্ক্রিনড আউট, আমি আর ফিরদৌস রেড কার্ড। তখন মনে হলো, গোটা বাংলাদেশের দায়িত্ব আমাদের হাতে আসবে না। হাজার হোক, একটা স্ক্রিনড আউটের হাতে কোনভাবেই একটা বাহিনীর দায়িত্ব দেয়া উচিত হবে না।

নাফিস আরেকটা জিনিস খুব পছন্দ করতো। সেটা হলো মাছ। যেদিন লাঞ্চের মেন্যুতে মাছ থাকতো, সেদিন নাফিসের জন্য ছিল ঈদের দিন। যেহেতু নাফিস প্রচুর মাছ খাচ্ছে, সুতরাং নাফিসের পাশে বসা মুজনাবিলও প্রচুর মাছ খাওয়া শুরু করলো।

একদম শুরুর দিকে নাফিসের ''অপছয়'' না করার যে কথাটা বলেছিলাম, তার আরেকটা নমুনা দেয়া যাক। নাফিস হরলিক্স নিয়ে আসলো। নাফিস ভাবলো, পরে খাওয়া যাবে, এখন তুলে রাখি। তুলে রাখতে রাখতে সেই হরলিক্স জমাট বেধে গেল, তবু নাফিস ভাবে আর কিছুদিন পরে খুলি। সবাই যখন বুঝে গেলো 'আর কিছুদিন পর' কখনো আসবে না, তখন হরলিক্সের জন্য হামলা(!) করা হলো। পরে দেখা গেল, হরলিক্সের মেয়াদ শেষ হয়ে ছাতা ধরার উপক্রম! অগত্যা সব হরলিক্স ফেলে দিতে হলো, কিন্তু নাফিসের 'আর কিছুদিন যাক' বলাটা ফেলে দেয়া গেল না।

নাফিসের পর্নোপ্রীতিরও আরেকটা উদাহরণ দেয়া যাক। নাফিস এখন এক্স ক্যাডেট। ঢাকায় থাকে ব্যাচেলর পয়েন্টে। সেখানে হয়ত একটা খেলার দিন সবাই খেলা দেখতে বসলো। দেখা যাবে নাফিস নাই। আচ্ছা, না থাকাটা সমস্যা না। সমস্যা হলো কিছুক্ষণ পর ওয়াইফাই স্পীড কমে যাবে। আরও কিছুক্ষণ পর নাফিসের রুমে এসে দেখা যাবে কম্বলের নিচে নাফিস ফোন চালাচ্ছে। ফোনে কি চালাচ্ছে, সে বিষয়ে আমরা জানি, কিন্তু বলবো না।

নাফিস কখনো রাত জাগতে পারতো না। লাইটিং শুরু হলেই বই নিয়ে ঘুমিয়ে যেত। ক্লাস সেভেনে একবার ফাইয়াজ ভাই রাউন্ডে এসে দেখলেন নাফিস বই নিয়ে ঘুমাচ্ছে। ফাইয়াজ ভাই বিখ্যাত বাংলা শাউট দিয়ে নাফিসকে ঘুম থেকে তুললেন। অতর্কিত শাউটে নাফিসের আধপাগলা মাথা পুরো পাগল হয়ে গেল। নাফিস বললো, "ভাইয়া বই, ভাইয়া খাতা, ভাইয়া টেবিল, ভাইয়া চেয়ার, ভাইয়া...", বলতে বলতে ঘুমে ঢলে পড়লো। এই অবস্থা দেখে ভাই নিজেই ভয় পেয়ে গেলেন!

টুয়েলভে যখন লাইটিং শুরু হলো, দেখা গেল নাফিস বই নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে। আমি যখনি বলি, "বই নিয়ে ঘুমানোর দরকার কি, শান্তি করেই ঘুমা।" নাফিস ঘুম থেকে উঠেই বলে, "কে ঘুমাচ্ছে? আমি ঘুমাচ্ছি না!'' কোন কোন দিন জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা করায় নাফিসের চোখ টকটকে লাল হয়ে যায়! আরেক নাইট প্রেপ চিন্ময় তখন নাফিসের কানের কাছে এসে গান গায়, "রেড আইজ, হিপনোটাইজ!" এরপর দেখা যায়, যখন নাফিস ঘুমায়, তখন চিন্ময় এসে হাসাহাসি করে, আবার যখন চিন্ময় ঘুমায়, নাফিস গিয়ে হাসাহাসি করে। 

সেন্ট মার্টিন(!)

নাফিসকে আমরা একটা বিশেষ নামে টীজ করতাম। সেটা এখানে উল্লেখ না করি। ধরে নিই, এই নামটা গরু। নাফিসকে আমরা ডাকি গরু। যেকারণে নাফিসকে আমরা গরু ডাকি, দেখা গেল সেই গুণটা নাফিসের ক্যান্ডির মধ্যেও বিদ্যমান। সুতরাং নাফিসের ক্যান্ডিকে আমরা নিজেদের মধ্যে ডাকতে থাকলাম জুনিয়র গরু। পরের বছর দেখা গেল তার যে ক্যান্ডি আসলো তার মধ্যেও এই গুণ আছে। সুতরাং তার নাম হয়ে গেল গ্র্যান্ড গরু। এরপর সুপার গরু। মানে নাফিসের ক্যান্ডিলাইন থেকে একটা গরুলাইন হয়ে গেল! আফসোস, জুনিয়ররা কেউ এটা জানে না, এই লাইনটা বোধহয় একসময় শেষ হয়ে যাবে! 

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে নাফিসের সম্পর্কে সবগুলো খারাপ কথা এতক্ষণ বলা হলো। আসলে কিন্তু মোটেও সেরকম না। নাফিস ছেলেটা খুবই ভাল একটা মানুষ। পর্ন দেখলেই মানুষ খারাপ হয় না। নাফিস যে ভাল মানুষ, সেটা জোর করে হলেও কয়েকটা উদাহরণের সাহায্যে দেখার চেষ্টা করা যাক।

প্রথমত, নাফিসের কাছে কোন হেল্প চাওয়ার পর কোনদিন ফিরে আসি নি। কোন না কোন কিছু করে, কিছু না পারলে অন্তত দুইটা ভাল কথা বলে সবসময় সবার পাশে নাফিস থাকতো। 

আমরা সাধারণত কী করি? যাকে অপছন্দ করি, তার সবকিছুই আমাদের বিরক্ত লাগে। নাফিস কখনো এই কাজ করার চেষ্টা করতো না। খুব বিরক্তিকর মানুষের মধ্যেও নাফিস বিশ্লেষণ করে দুয়েকটা ভাল-মানুষি বের করতো। মানে নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করার ইচ্ছাটা অন্তত ছিল। 

আমি সবসময় এমন সব মানুষকে খুব পছন্দ করি, যারা জানে তারা কী করছে। ভুল কিছু করুক, কিন্তু নিজের জায়গা থেকে সচেতন, একটা আদর্শ থেকে কিছু করার চেষ্টা করছে। নাফিস সবসময় এই কাজটা করতো। নাফিসের একটা নিজের আদর্শ ছিল। কখনো নাফিসকে তার বাইরে যেতে দেখি নি।

এখনও রংপুরে কোথাও গেলে নাফিসের বাড়ির কথাই আমার সবার আগে মনে পড়ে! খাওয়া-দাওয়া কম করার নিশ্চয়তা দিলে আরও বেশি যাবো অবশ্য!


এরকম হাজারো ভালোমানুষি নিয়ে আমাদের নাফিস। বেশি ভাল কথা বলা উচিত না, কিছু ভাল কথা নিজের কাছেই থাকুক। নাফিস ছেলেটা এমনিতে সত্য কথা বলে, কিন্তু আমার সাথে বলে না। শীতের দিনে নাফিস সবসময় আমার গায়ে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে বলতো, "আমি না, কোন এল-টাইপ পানি দিলো!" ফর্মে মুনতাসিনের সাথে চেয়ার-টেবিল নিয়ে মারামারি, বাথরুমে ইসলামের সাথে মারামারি - আমার মনে পড়লেই হাসি পায়!

এই আমাদের নাফিস, গোসল করে তোয়ালে পরে আসার পথে যার ভুড়ি ইঞ্চিদুয়েক বিস্তারে লাফালাফি করতো, টুথব্রাশ দিয়েও যে পিটানো যায় এই বিষয়টা দেখিয়ে যে আমাদের আলোকিত করেছিল, মার খাওয়ার আগেই ব্যথার অভিনয় করে যে ধরা খেয়েছিল, ভুল ক্যাডেট নম্বর বলে যে ইডি খাওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিল, যার কলিজা একটা পোয়াটাক মুরগির কলিজার চেয়ে কোন অংশেই বড় না, প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে যার দিকে কিছুক্ষণ তাকালে অবশ্যই মন ভাল হয়ে যেত!

ক্যাডেট কলেজের একদম শুরুর দিনগুলোতে বাঁয়ে তাকালে নাফিসের হাসি-হাসি মুখ দেখতাম, একদম শেষদিনটাতেও ডানে তাকিয়ে দেখলাম নাফিসের জলভরা একজোড়া চোখ। এরপর একসাথে থাকলাম ফার্মগেট। একসাথে থাকাটা যেন এ জন্মে শেষ না হয়! 

নাফিস, তুই বাইরে যতই খয়ের খাঁ হওয়ার চেষ্টা করিস, ভেতর থেকে তুই প্রচণ্ড আদর্শবাদী একটা মানুষ। বাইরে তুই যতই কুপন বাঁচানোর চেষ্টা করিস, ভেতর থেকে তুই খুব উদার মানুষ। তুই হয়ত জানিসও না, ভেতর থেকে কত সরল একটা মানুষ তুই!

একজন এল-টাইপ ভাল মানুষের জন্য শুভকামনা।

"যাচ্ছে সময় যায় যে চলে 
চিলেকোঠায়, চার দেয়ালে।
তুমি এসো, ভালোবেসো
আমি তোমায় বেঁচে রই।
বন্ধু গো, আজ তোমায় 
বড় বেশি প্রয়োজন!"

React

Share with your friends!



Also Visit:

জেনে নিন নাফিসের চোখে আপনি কতটা 'এল-টাইপ'!


Comments