বড় আশা নিয়ে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলাম।
এডমিন ডে তে মাথার যাবতীয় চুল বিসর্জন দিয়ে পরেরদিন গেলাম ফর্মে। গিয়ে শুনলাম
যাদের ক্যাডেট নম্বর বেজোড় তারা নাকি এ ফর্ম। এ ফর্মে ঢুকে দেখি আরেক কাণ্ড!
সবাইকে নাকি ক্যাডেট নম্বর অনুসারে বসতে হবে। ভিজিটর্স ডেস্কে সীট প্ল্যান দেয়া
ছিল। বিস্তর ধাক্কাধাক্কি করে টিকতে না পেরে ভাবলাম, দেখবই না সীট প্ল্যান,
যেখানে ফাঁকা থাকবে সেটাই আমার সীট।
সবাই হুড়োহুড়ি করে বসে গেল। দেখলাম একটাই সীট ফাঁকা পড়ে আছে। পেছন দিকে একটা মোটা
হাঁদা বসে আছে, তার পেছনের সীটটায় গিয়ে বসে পড়লাম। সামনের সেই “মোটা হাঁদা”কে
দেখে বিরক্তির সাথে ভাবলাম, আমাকে কী সারা ক্যাডেট জীবনই এই ভোটকাটার পেছনে বসতে
হবে? ভোটকাটা কিছুক্ষণ পর আমার দিকে ফিরে বলল, আমার নাম ফাহিম। ব্যাটা তোর নাম কে
জানতে চেয়েছে, এমন দৃষ্টি দিয়ে বললাম, ও, আচ্ছা। ছেলেটা দ্বিগুণ উৎসাহে বলল,
তোমার নাম কী? আমি ততোধিক বিরস মুখে বললাম, মোহাইমিন।
একদিন দেখলাম, ফাহিম নামের ওই ভোটকাটা মার্শাল লেখা একটা জ্যামিতি বক্স নিয়ে
ফর্মে ঢুকল। তার কিছুক্ষণ পর আমার কী যেন একটা কাজে কম্পাস লাগত। আমি এবার বিরস
মুখটাকে একটু হাসি হাসি করে বললাম, ভাই, তোমার কাছে কম্পাস আছে? কোন স্যারের
ক্লাস চলছিল, আমার মনে নাই। সে ক্লাসে এমনভাবে মনোযোগ বাড়িয়ে দিল, যেন আমার কথা
শুনতেই পায় নি! আমি আবার ডাক দিলাম, এবার ভোটকাটা চোখ কুঁচকে রাজ্যের বিরক্তি
নিয়ে বললো, আমার কাছে কোন কম্পাস নাই, ক্লাস করো। আমি এই উপদেশে থতমত খেয়ে গেলাম।
ইচ্ছা করলো তৎক্ষণাৎ একটা চড় বসিয়ে দিই। ব্যাটা ভোটকা হাঁদা, একে তো কম্পাস দিলো
না, তার ওপর আবার ক্লাস করতে বলে। অনেক কষ্টে এই ইচ্ছা সেদিন দমন করেছিলাম।
এই হাঁদারামটার নাম আমি আগেই বলে দিয়েছি, আবার বলে দিই। ফাহিম মোর্শেদ, মোটামুটি
নিরীহ প্রাণী। আজকের লেখাটা এই প্রাণীটাকে নিয়েই।
এই ছেলেটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় তেমন মনে রাখার মত কিছু না, বরং সত্যি কথা বলতে
আমি এই মোটা ছেলেটাকে তেমন একটা পছন্দ করতাম না। কিছুদিন পর কাওসার নামের একটা
ছেলে চলে গেল। আমি কাওসারের সীটে চলে এলাম, সামনে ছিল
হাবিব
। মনে মনে ভীষণ খুশি হলাম, অন্তত এই ভোটকা ছেলেটার পেছনে বসতে হবে না।
ক্লাস সেভেনের ভোটকা ফাহিম (ডানে) |
ক্লাস সেভেনের আরেকটা ঘটনা বলা যেতে পারে। ভাইয়ারা তখন আমাদের মধ্যে হাউজ ফিলিংস
নামক একটা ওষুধ পারলে ইনজেকশন করে ঢুকিয়ে দেন। আমরাও রীতিমত উৎসাহী। এর মধ্যে
প্রথম ফোর্টনাইটলি শুরু হবে বলে জানা গেল। ভাইয়ারাও একাডেমিক্স নিয়ে বিস্তর
আলোচনা করলেন। প্রথম পরীক্ষার দিন আমি ঘোষণা করলাম, আমার হাউজ ব্যতীত কারও সাথে
পরীক্ষায় কোন কথা বলবো না। পরীক্ষা দিলাম। ফল ঘোষণার দিন দেখা গেল ফাহিম একটা
অসাধারণ রেজাল্ট করে ফেলেছে, আর আমি প্রায় লাড্ডু। সাথে সাথে এই ঘোষণা বাতিল করে
দিলাম, ফাহিমকে গিয়ে বললাম, পরীক্ষার হলে ক্লাসমেটের ওপরে কোন কথা নাই। সেদিন কি
জানতাম, না জেনেই কী ভীষণ সত্যি একটা কথা বলে ফেলেছি!
যেই কথা যেই কাজ। জেএসসি পরীক্ষায় কৃষিশিক্ষা বইয়ে কী আছে প্রায় না জেনেই আমি
বৃত্তি পেয়ে গেলাম। বাংলা পরীক্ষায় গিয়ে প্রথম আবিষ্কার করলাম মোস্তফা মনোয়ার
নামে কোন শিল্পী নাই, আসল নাম মুস্তাফা মনোয়ার! আরও অনেক কিছু নতুন করে জানলাম,
কারণ জেএসসি পরীক্ষায় আমার সামনে ফাহিম নামের এই ছেলেটা ছিল! এই জায়গায় অবশ্য
মেহেদিও
কিছু অবদান রেখেছিল।
পাঠক, এই পর্যায়ে এসে ভাববেন না আমি পরীক্ষায় খুব দুনম্বরি করতাম। এই কথাটা আংশিক
সত্য। তবে আমি ক্লাস নাইনে ওঠার পর থেকে আর কখনো কারও দেখে কিছু লিখি নি। যথাসময়ে
এ বিষয়ে আরও কিছু বলা হবে।
তবে সবকিছুরই ব্যতিক্রম থাকে। কথায় বলে, Necessity knows no law. আমি নাইন-টেনে
একদম বায়োলজি পারতাম না, এসএসসি পরীক্ষায় বায়োলজিতে আমি যে নম্বর পেয়েছি, তার
অর্ধেক ছবি এঁকে পেয়েছি, বাকি অর্ধেক পেয়েছি আবার ওই মোটা হাঁদাটার কাছে।
পরীক্ষায় যাতে আর দুনম্বরি করতে না হয়, তাই আমি এর পরে আর বায়োলজিই পড়ি নি।
ক্লাস সেভেন আর এইট চলে গেল। পরীক্ষার হলেই হোক বা অন্য কোনভাবেই হোক, এর মধ্যে
ফাহিমকে আর অতটা বিরক্ত লাগে না। উনিশ তেত্রিশ আর পঁয়ত্রিশ মিলে ফর্মে একটা দারুণ
মানিকজোড় হয়ে গেলাম।
এ পর্যায়ে আমি একটু নিজের কথা বলি। দিনের মধ্যে একটা বড় অংশ ক্যাডেটরা ফর্মে
কাটায়। তবু আমার মনে হয়, নিজের হাউজের না হলে একটা ক্যাডেটকে ভালভাবে চেনা যায়
না। ফাহিম আমার হাউজের ছিল না। আমি তার নাড়ি নক্ষত্র জানি না। এই লেখায়
পুঙ্খানুপুঙ্খ চরিত্রবিশ্লেষণ সম্ভব না। আমার সাথে ফাহিম যেমন ছিল, সেরকমই লেখার
চেষ্টা করবো। তোর সাথে আমার বেশিরভাগ আলোচনা কেবল ফর্ম থেকে ডাইনিং হলে যাওয়ার
ফলইনে কিংবা হঠাৎ ফর্মে কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, অথচ কী গভীর বন্ধুত্বটাই
না হয়ে গেল এরই মধ্যে!
ক্লাস নাইনে উঠতে উঠতে আমি চলে আসলাম আমার বিখ্যাত পেছনের কোণার সীটটাতে, তুই
কীভাবে যেন সামনে চলে গেলি। তবু ঘন ঘন যোগাযোগটা বোধহয় টিকে থাকল সেই বাঁশের
কেল্লার জন্য! এখনো সেই বিবিকে পার্টির দিনগুলা মনে করলে মনটা ভাল হয়ে যায়।
মুড়িতে তেল দেওয়ার সময় দেখা যেত,
Swad
তেল খাবে না। এই উপলক্ষে অন্য খাবারদাবার সব সোয়াদ আগেই খাওয়া শুরু করে দেবে,
আবার পরে মুড়ির ভাগটা ঠিকই নিয়ে নেবে। কেউ না কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি আসত, একটা
অক্সফোর্ড ডিকশনারি নিয়ে খোঁজা হত ত্রিপদী নাম। প্রথমটার নাম ছিল ফি-বেটা-কাপা।
দেখা যেত, প্রত্যেকবার পার্টি শুরু হওয়ার ঠিক আগে আগে লীডার হাবিব নিখোঁজ!
খাওয়াদাওয়ার পর Soikot কোন না কোন ইস্যু বের করে নাচানাচি করত। মুড়ি নেওয়ার সময়
সবাই কী সুন্দর হাত গোল করে খাচ্ছে, আর
Hassan
এর হাত সবসময় ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের মত চোখা হয়ে থাকত। স্বভাবমতো
আরেফিন
কিছু না কিছু নিয়ে হাসিতামাশা করলেও তলে তলে সব খাবার দ্রুত শেষ করে দিত।
Sifat
তও কিছু না কিছু নিয়ে কারও সাথে তাল দিচ্ছে। পরে এই পরিবারে
Muznabil
,
Rafsun
,
Fardin
আসলো। ফর্মে লীডারের কত রকমের আদেশ। কেউ কোন বোরিং জোকস বললে আদেশ হত, বাঁশের
কেল্লা, হাসবে, হাসো! এই আদেশ দিয়ে একবার মহিউদ্দীন স্যারের কাছে ধরা খাওয়া হল।
রাফসান সবাইকে কলমের হেড দিয়ে বাঁশ দিত, কাউকে কাউকে বোর্ডপিন বাঁশ দেওয়া হত।
একটা বোর্ডপিনের গুঁতা পাছায় যে খায়নি, তার পক্ষে এই "কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে
কিসে" কবিতাটা সার্থক! কতই না ভাল দিন ছিল!
একেকটা বিবিকে মুড়ি পার্টিতে প্ল্যান-প্রোগ্রামের জন্য তোর কী খাটাখাটনি! এই যে
নির্দ্বিধায় মানুষজনকে সাহায্য করার এই অভ্যাসটা সারাজীবন ধরে রাখিস। কিন্তু কথায়
কথায় ব্যাঙের মত মুখ করে হাসাহাসি বন্ধ করবি। দেখলেই আবার ক্লাস সেভেনের সেই
বিরক্তির কথা মনে পড়ে যায়।
আমার কীভাবে যেন হাসানের সাথে একটা ভাল সখ্যতা ছিল। মানুষ হিসেবে আমি হাসানকে আমি
খুবই পছন্দ করি। এর মধ্যে দেখা গেল, তুই আর
Asib
, দুই বিশেষ জাতের পক্ষী, হাসানকে নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকলি। আমি সেই
নির্যাতনের বিরুদ্ধে কলম হাতে তুলে নিলাম! যা হোক, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। হাসানকে
একসাথে নির্যাতনের সময় তোর সাথে আসিবের খুব ভাল সম্পর্ক হয়ে গেল। ভাল মানুষের
সাথে খারাপ মানুষ মিশলে বেশিরভাগ সময় দুজনই খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু দুইটা ভাল
মানুষ একসাথে হয়ে কীভাবে এত খারাপ হয়ে যায়, আমার জানা নেই। তোরা দুজনই ভয়ঙ্কর
রকমের শুয়োর হয়ে গেলি। হয়ত তোদের এই নিষ্পাপ পক্ষীজাতের মধ্যে কোথাও একটা গোলাপী
শূকর ঘুমন্ত ছিল, একসাথে হয়ে সেটা ভীষণভাবে জেগে উঠেছিল।
নাইন টেনে উঠে তুই অন্য লেভেলের ব্রিলিয়ান্ট হয়ে গেলি। দেখা গেল ফিজিক্স বা
অঙ্কের এমন সব জটিল প্রশ্ন কোত্থেকে জোগাড় করে আনিস, আমি কিছু পারি না। এতদিন
জানতাম, পাইপ শুধু সোলায়মানি ডাণ্ডা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তোর কাছে আমি
প্রথম শুনলাম, লোহার পাইপের এক মাথায় শব্দ করলে দুইটা শব্দ শোনা যায়, এই দুইটা
শব্দ শোনার পার্থক্য জানা থাকলে নাকি আবার সেই পাইপের দৈর্ঘ্যও বের করে ফেলা যায়।
কিংবা কূয়ার মধ্যে পাথর ফেললে শব্দের বেগেরও কী জানি কাহিনী আছে! তোর বাড়ি ঢাকায়,
সেই সুবাদে ঢামেকিয়ান, বুয়েটিয়ান কারও কাছে এসব উলটাপালটা জিনিস শিখে আসতি। আমি
তখন কোন সমস্যা পেলে খুব কনফিডেন্সের সাথে সলভ করে ফেলি। আমার ধারণা, যখন তোর
দেওয়া সমস্যাগুলো পারতাম না, মুখ বাঁকিয়ে এগুলো চিন্তা করতাম, এটা দেখে তোর
পৈশাচিক আনন্দ হতো। এখন বুঝি, আঁতেল বড় ভাইয়েরা এসব ইলেভেন টুয়েলভের সমস্যা তোকে
নাইন টেনে দিত। আর তুই সেটা আমার মতো কোমলমতি বাচ্চার ওপর চালিয়ে দিতি!
বন্ধু দিবসে সবার শখ হল, হাতে ব্রেসলেটের মত করে কাগজ লাগাবে, সবার শুভেচ্ছা বাণী
লেখা থাকবে৷ আমি ওসব লাগাই নি। কিন্তু তুই আমাকে যে কাগজ দিয়েছিলি, সেটা টুয়েলভ
পর্যন্ত আমার ডেস্কে ছিল! "মিছা কথা কয়া লাভ আছে? মিছা কথা কয়া লাভ নাই", আমি এখন
ওটা হারিয়ে ফেলেছি। তবে এতদিন ছিল, এটা সত্যি।
ইলেভেনে উঠতে উঠতে তুই খেলা পাগল হয়ে গেলি। দিনরাত ফুটবল দেখিস, আর
Akhter
দের সাথে ফুটবলের গল্প করিস। যথারীতি আমি তার একবর্ণ বুঝি না। মাঝে মাঝে ফর্মে
আমার কাছে আসিস ডিস্টার্ব করতে। এটা সেটা গল্প হয়। কিন্তু তোর ওই ভোটকা শরীর আবার
আগের মত ফুলতে শুরু করেছে। মোটা শরীর নিয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারিস না।
এদিকে আমি নিতান্ত শুকনা মানুষ বিধায় বসতেও কম জায়গা লাগে। এই সময় ‘দোস্ত, একটু
চাপ’ বলে আমার চেয়ারটার প্রায় পুরোটাই নিজের উৎকট ও বৃহৎ পশ্চাদ্দেশের দখলে নিয়ে
আসিস। কোনমতে ওপাশে দেয়াল থাকায় চেয়ারে টিকে থাকি। আস্তে আস্তে তোর এই চেয়ার
দখলের কায়দাটা আমি বুঝে গেলাম। সুতরাং আর চেয়ারের ভাগ দেওয়া চলে না। ইলেভেনে তুই
সবার জেপিশিপের জন্য বাজি ধরে নিজেই ফোর্থ স্পেলের জেপি হয়ে গেলি।
ইলেভেনের আরেকটা গল্প বলা যায়। কোন একটা টার্মের আইসিটি পরীক্ষা চলছে। কোন একটা
কারণে তুই আমাকে ডাক দিলি। আমি পিছনে ঘুরলাম। গার্ড ছিলেন শক্তি স্যার। অজ্ঞাত
কারণবশতঃ তিনি আমাকে খুব খারাপ একটা মানুষ মনে করতেন বলে আমার ধারণা। প্রায় ঝড়ের
গতিতে আমার খাতা উধাও হয়ে গেল। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। আমার প্রায় সব দাগানো হয়ে
গিয়েছিল, বাকি দুয়েকটা ছিল, সেগুলোতে অপু-দশ-বিশ করতে শুরু করেছিলাম। সুতরাং
এগুলো না দাগানোয় আমার খুব একটা কষ্ট হলো না। এর মধ্যে আরেক দায়িত্বপ্রাপ্ত
শিক্ষক ছিলেন তুষার স্যার। অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলেও খাতা চাই নি। তিনি এসে বললেন,
খাতা তো শক্তি স্যারের কাছে, সরি টরি বলো। আমি উঠে দাঁড়ালাম, অডিটোরিয়ামের এমাথা
থেকে ওমাথায় শক্তি স্যারের কাছে আমার গলা পৌঁছাবে না, তবে তিনি বুঝবেন খাতা চাইতে
দাঁড়িয়েছি, এই আশায় তেমন কোন কথাবার্তা বললাম না। তিনি আমার দিকে একপলক তাকিয়ে
যখন দেখলেন আমি কিছু বলছি না, তখন নিজের মত গার্ড দিতে শুরু করলেন। অতএব,
কিছুক্ষণ খুঁটির মত নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকার পর মুখে কথা বের হল। স্যার কাছে এসে
বললেন, - বলো কেন তোমার খাতা আমার কাছে?
- স্যার, পেছনে তাকিয়েছিলাম।
- কেন?
এর উত্তর দেওয়া চলে না। অগত্যা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর যখন বুঝলাম কিছু না বলা
পর্যন্ত এই শীতল দৃষ্টি আমার ওপর থেকে সরবে না, আমি বললাম, একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস
করতাম। সরি টরি বলে ভাবলাম সে যাত্রা বেঁচে গেলাম। কিন্তু শক্তি স্যারের নজর থেকে
রেহাই পাওয়া এত সহজ না। পরের পরীক্ষায় সীট প্ল্যান দিতে এসে বি ফর্মে বলে গেলেন,
তোমাদের মোহাইমিনকে সাবধান করে দেবে! এরপর থেকে আমার প্রতি স্যারের ধারণা পূর্ববৎ
রইল কিংবা তার সামান্য অবনতিও হতে পারে।
ক্লাস ইলেভেন পার হয়ে গেল। এই বন্ধুত্বটা বাড়তেই থাকল। আমরা টুয়েলভে উঠে গেলাম।
টুয়েলভে ছেলেদের মাঝে ফলইনে একজন আরেকজনের পশ্চাদ্দেশে তুমুল বেগে চপেটাঘাতের
একটা প্রবণতা দেখা গেল। কোন বৃষ্টিমুখর ফলইনে হাউজের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম, Ragib
তখন কিভাবে যেন সবার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এল। সবার মধ্যে রাগিবকে নিয়ে
ফ্যান্টাসি। কেউ তাকে এই “পশ্চাদ্দেশে চপেটাঘাত” দিতে সাহস পায় না, পাছে রাগিব মন
খারাপ করে। এই সময় ফাহিম আমাকে অফার দিল, একবার মারবি, পুডিং দিব। আমার মধ্যে
পুডিংয়ের লোভ তেমন একটা ছিল না, তবে কী মনে করে রাজি হয়ে গেলাম। আমার হাড্ডিওয়ালা
বাঁহাতে ভালই জোর ছিল। ঘটাং করে একটা মার বসিয়ে দিলাম, সাথে সাথে রাগিব ‘ইশশ’ বলে
আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিক্ষেপণ করল। আমি হাসতে হাসতে বললাম, দোস্ত, হাফ পুডিং তোর,
হাফ আমার। ফাহিম বাজি ধরেছিল! সেখানে বেশিক্ষণ থাকা চলে না, আমি দ্রুতপায়ে সরে
আসলাম। আমার ধারণা, সেদিন রাগিব আমার ওপর যারপরনাই বিরক্ত হয়েছিল। রাগিব, ওসব
কিছু মনে রাখিস না, সব ভোটকা ফাহিমের দোষ।
পরে ফাহিম বললো, সত্যি সত্যি মেরে দিলি! আমি অবশ্য ফাহিমের পুডিংটা পেয়েছিলাম,
কিন্তু রাগিবকে আর তার অর্ধেক পাঠানো হয় নি।
আমরা এইচএসসি দিলাম, সেখানেও আমার সামনে তুই। এবার ভাবলাম, বায়োলজি নাই, কারও
কাছে কোন হেল্প লাগবে না। কিন্তু বিধি বাম! ফাহিম আমাকে বলে দোস্ত, এটা কী, ওটা
কী। আমি যা লিখেছি, তাই বলি। কিন্তু এবারও ফাহিমই নায়ক, আমাকে বলে, আরে, এটার
উত্তর এটা না তো, সবাই ওটা লিখেছে, আমারও মনে হয় ওটাই হবে। অতঃপর, সকল পরীক্ষায়
আমার সামনে বসা ছেলেটা আমাকে সমানে সাহায্য করে গেল।
আরেকটি ঘটনা দিয়ে শেষ করে দিই। ক্লাস টুয়েলভে শেষবারের মত ফর্মে গিয়েছি। আর ফর্মে
আসা হবে না, সবাই খুব আবেগপ্রবণ হয়ে গেল। কিন্তু একটু গানটান করে এই আবেগ
বেশিক্ষণ টিকল না, আবেগ ধীরে ধীরে হিংস্রতার দিকে মোড়। প্রথমে কাগজের বল দিয়ে
মারামারি, তারপর শুরু হলো গণ। একজনকে ধরে সেই বিখ্যাত ‘খাজুরিয়া মাইর’। শেষ
সিরিয়াল আসলো ফাহিমের। ফাহিম এসব বিষয় হয়ত একটু ভয়টয় পেত, অনেকদিন থেকেই মার
খাওয়ার কথা কিন্তু পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর জন্য সবার ইচ্ছা হল এতদিনের সবকিছু
একদিনে শোধ দিতে হবে। ফাহিম আবার পালালো। কিন্তু শেষদিন, পালিয়ে যাবে কোথায়!
ওয়াশরুম থেকে পাকড়াও করা হলো। বদরুদ্দোজা স্যার ছিলেন ব্লকের দায়িত্বে। শেষদিন
বিধায় তিনিও আমাদের কিছুটা ছাড় দিয়ে সিঁড়ির কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিলেন। ফাহিম এবার
শেষ রক্ষা হিসেবে গেল স্যারের কাছে। ছেলেপেলেও শেষদিন উপলক্ষে নাছোড়বান্দা।
স্যারের সামনেই টানাটানি শুরু করল। স্যার বললেন, কী বাচ্চাদের মতো করো, যাও ফর্মে
যাও। ফাহিম করুণমুখে বললো, স্যার, মারবে তো! স্যার সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন,
যাও যাও, বেশি মারবে না। এই তোমরা একটু আস্তে মারো! এই কথা শুনে ফাহিমের যে অসহায়
মুখ আমি সেদিন দেখেছি, এখন আর কুমিল্লার মোরসালিনের মিম দেখলেও আমার হাসি পায় না।
ফাহিম ছিল একাধারে একজন অতিরিক্ত পর্যায়ের ভাল ছাত্র এবং একজন ভাল খেলোয়াড়।
ভলিবল, বাস্কেটবল, ক্রিকেট, ফুটবল সবকিছুতেই অসাধারণ নৈপুণ্য ছিল তার। সংস্কৃতির
মঞ্চেও খারাপ ছিল না। তবে রেবা ম্যাডামের পাবলিক স্পিকিং ক্লাসে সামান্য কলঙ্ক
আছে।
একটা মানুষ সমাজের জন্য কী করলো, সেটা দেখে আমরা ভালমানুষের খেতাব দিই না। আমরা
দেখি আমাদের সাথে সে কেমন। একটা মানুষ যত ভালই হোক, আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে
আমার মন তাকে খারাপ বলার দিকেই বেশি সাঁয় দেবে। ফাহিম ছেলেটা আমার সাথে কোনদিন
খারাপ ব্যবহার করে নি। আমি অনেক ভালমানুষ দেখেছি, কিন্তু তাদের মধ্যেও খারাপ কিছু
না কিছু থাকে। তোর মত খাঁটি ভালমানুষ আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। আমার মত মানুষকে
ভালবাসার কোন কারণ আমি দেখি না, তার ওপর আমি সবসময় নিজের মতামতটাকে প্রাধান্য
দিই। আর তোর প্রতিটা কথার জবাব আমি সাধারণত দিই বিরক্তমেশানো গলায় ‘ধুর’! এতকিছু
মানিয়ে সবসময় একটা মানুষ শুধু ভাল ব্যবহারই করে যাবে, কখনও অভিযোগ করবে না,
নাকউঁচু ভাববে না, এরকম একটা একতরফা ভালমানুষি কেন জানি ফাহিমের স্বভাবে মিশে
আছে।
একটি ছলনাময় পোজ |
আমি জানি না তোর কথা মনে হলে কেন আমার অমন দুঃখ মেশানো ভাললাগা কাজ করে, সব
দুঃখজাগানিয়া গানের কথা মনে পড়ে! আর এসব লিখতে গেলে আমার মনটা বিশ্রীভাবে খারাপ
হয়ে যায়, আমি কলেজের একরকম আগাছা হয়েও যেন কীভাবে কলেজের স্মৃতিতে অনেকদূর শিকড়
বিছিয়ে দিয়েছিলাম! মন খারাপ না হলে এসব লেখা আসে না। তবে আমি যথাসম্ভব চেষ্টা
করেছি সুখস্মৃতিগুলো মনে করতে।
ফাহিম, আমাদের মনে রাখিস, আমাকে মনে রাখিস। তুই ভাল থাক। চিরকুটের একটা অতি
পুরাতন এবং দুর্লভ গান দিয়ে শেষ করি-
“আকাশে ভাসে তারা, জোয়ারে রঙের খেলা
ঢেউয়ে নাচে মেঘের ছায়া, মনেতে বন্ধুর মায়া
বন্ধু তুই আমার ভোরের পাখি হয়ে থাক
দুপুর রোদে গাছের ছায়া হয়ে থাক
বন্ধু তুই পালক হয়ে ছুঁইস আমার মনের খোয়াব
বন্ধু তুই আমার ভোরে আয়!”
আমার গলা ভাল হলে এই ‘আয়’ বলার সময় যে টানটা দেয়, ওটা গেয়ে শোনাতাম। আমার খুব
পছন্দের একটা গান।
অনেক বুড়ো হয়ে গেলেও মাঝে মাঝে এই লেখাটা যদি পড়ি, সেটা দেখেও অন্তত যেন আমার কথা
মনে পড়ে সেই ব্যবস্থা করে গেলাম।
Comments
Post a Comment