Recent Posts

বন্ধু এসো স্বপ্ন আঁকি চারটা দেয়াল জুড়ে

 

rafsun
 

আমার প্রায় সব বন্ধুদের আমি পছন্দ করি। তবে সবাই যে খুব ভাল মানুষ তা না। আমার বন্ধু এবং পছন্দের মানুষের তালিকায় কিছু খারাপ মানুষও আছে। আমার জীবনে যে কয়েকজন সত্যিকারের ভাল মানুষ, খোলা মনের মানুষ দেখেছি, তাদের মধ্যে একজন রাফসান। এরকম খাঁটি মানুষের দেখা পাওয়া দুষ্কর।

আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি, আমাদের ব্যাচটা কেমন হত, যদি রাফসান না থাকতো! আমার সামনের ডেস্কে অন্য কেউ বসতো, কেউ ফর্মে তথাকথিত বাঁশ দিত না, কেউ Zubaer এর নাক টানাটানি কিংবা দাঁত টোকাটুকি নিয়ে টিজ করত না, মচমচে একটা টিকটিকি দিব্যি হাপিস করে দেওয়ার মত কেউ থাকত না, এতগুলো গণ আমরা কাকে দিতাম! সব মিলিয়ে আমাদের ইনটেকের হাসি তামাশা আর গল্পগুলো সব অর্ধেক হয়ে যেত।

ক্লাস সেভেনে প্রথমদিকে আমি অনেকের রুমে ঘোরাফেরা করেছি। আসলে মানুষজনের সাথে দেখা করতে যেতাম, এরকম না। মাঠে-ঘাটে, ডাইনিং, মসজিদ, একাডেমিক্স, বাথরুম, ব্লক – সব জায়গায় উলটাপালটা কাজকর্ম করতাম। তাই বিভিন্ন রুমলীডার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রুমে ডাকতেন। এরকম সময়ে সবার সাথেই ভাল পরিচয় হয়ে যায়। কিন্তু রিজভি ভাই ভাল মানুষ বিধায় ১০৬ নম্বর রুমে খুব কম গিয়েছি। রাফসান এই রুমের বাসিন্দা হওয়ায় বাথরুম ছাড়া খুব একটা দেখা হত না। তারপর ফর্মে গিয়ে লম্বা কিন্তু চওড়া না, ফর্সা কিন্তু সুন্দরী না, এরকম রাফসানের সাথে দেখা হলো। রাফসান বেশ লাজুক ছিল। কারও সাথে তেমন কথাবার্তা বলত না, শুধু
Akhter
এর সাথে সারাদিন কীজানি গল্প করত!
ক্লাস সেভেনে শুরুতে একটা পরীক্ষা হয়, ওখানে দেখা গেল রফসান প্রথম হয়ে গেল! তারপর ফোর্টনাইটলি হল, ওখানেও দেখি রাফসান সবার ওপরে। আমাদের হাউজে আমরা বেশিরভাগই গরুগাধা ছিলাম, প্রতিবার একাডেমিক্সের রেজাল্ট জমা দেওয়ার সময় ক্লাসলীডারের মুখ শুকিয়ে যেত এবং প্রতিবারই সবাই মিলে নতুন নতুন অজুহাত তৈরি করতে হতো। এরকম সময়েও এই ছেলেটার জন্য আমরা অনেকবার নীল হাউজের সাথে তুমুল প্রতিযোগিতা করে লাস্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি!

কলেজ ফেয়ারওয়েলের দিনে রাফসান-আখতার

ক্লাস এইটে এই ছেলেটা ওপর-নিচ সবদিক থেকেই রীতিমত পাল্টে গেল! সেভেনে প্রেয়ারের পর এবং প্রেপের আগে ১১৯ নম্বর রুম আমাদের জন্য একটা ভয়ানক বিভীষিকা ছিল। এইটে যখন দেখলাম এখন আমরাই এখানে থাকি, এই খুশিতেই কারণে অকারণে এই রুমে ঘুরতে যেতাম এবং অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড দেখতাম। এই রুমের প্রতিটা প্রাণী ছিল একেকটা দর্শনীয় বস্তু। এখন সেসব গল্প করতে গেলে আমাদের নেভি এবং আর্মি অফিসার ক্যাডেটদের সম্মানহানি হতে পারে! থলথলে
Shahib
কে বিছানার ওপর এমনভাবে হাহা হিহি করতে দেখতাম, দেখে মনে হত একটা ফুটবল গড়াগড়ি করছে। গুটি আমের মত
Ishtiaque
উদ্বিগ্ন চোখে এদিক ওদিক করত।
Zahin
সারাদিন এটা ওটা ভাবত। এদের মধ্যে রাফসানকে দেখলে আমার সবসময় সুকুমার রায়ের হুঁকোমুখো হ্যাংলার কথা মনে পড়ত – “হুঁকোমুখো হ্যাংলা, বাড়ি তার বাংলা/গালভরা ছিল তার ফুর্তি/গাইতো সে সারাদিন, সারেগামা টিমটিম/ আহ্লাদে গদগদ মূর্তি!”। এই সময়ে রাফসানের ভদ্রতা আর লজ্জার খোলস অল্প অল্প করে কমে গেলো।

ক্লাস এইটের একটা কথা বলা যায়। এই রুমের প্রায় সবাই অত্যন্ত ভীতু প্রকৃতির ছিল। রাফসানের ভয়ের নমুনা দেওয়া যেতে পারে। গভীর রাতে দুই অতি উৎসাহী ক্যাডেট রাফসান আর জাহিনের খাটের নিচে ঢুকে খটখট করে শব্দ করা শুরু করল। রাফসানের ঘুম ভেঙে গেল। কোনমতে গলা দিয়ে শব্দ বের করে জাহিনকে ডাকল।
-“কিরে, তুই কোন শব্দ পাচ্ছিস?”
-“হ্যাঁ রে, আমিও তো পাচ্ছি।”
-“আমি তো বুঝতে পারছি না! এ আবার কী আসলো!”
-“ভাই, আজকে মনে হয় জীবনের শেষ দিন। যত দোয়া জানিস সব পড়া শুরু করে দে!”
দুইজন মিলে উচ্চস্বরে জানা-অজানা, অর্ধেক জানা, অর্ধেক বানানো, আরও নানা জাতের দোয়া দরূদ পড়া শুরু করে দিল। খাটের নিচের ভূতেরা এই ঘটনায় আর হাসি থামাতে পারল না। সেদিন কারও জীবনের শেষ দিন ছিল না। অতঃপর আমাদের গল্পের নায়কেরা এখনো দিব্যি বেঁচে আছে!

ক্লাস এইটের আরেকটা ঘটনার জন্য রাফসানদের কৃতজ্ঞতা জানানো জরুরি। একবার ক্লাস টেনের কেউ একজন আমাকে বলে গেলেন, সবাইকে বলতে কেউ যেন রুম থেকে বের না হয়। আমি সব রুমে বললাম। কী কারণে সবার পরে গেলাম রাফসানদের রুমে। ওখানে গিয়ে কী জানি কাণ্ড দেখে আসল কথা ভুলে সেই আড্ডায় যোগ দিলাম। এরপর খুব স্বাভাবিকভাবে রাফসান ওয়াশরুমে গেল। যাওয়ার পথে তাহমিদ ভাই পথ আটকালেন, রুম থেকে বের হতে নিষেধ করার পরও কেন রুমে থেকে বের হয়েছে এইজন্য। রাফসান বললো, ভাইয়া আমি তো কিছু জানি না। ভাই বললো, তোমার রুমমেটরা তোমাকে বলে নি? রুমমেটরা কীভাবে বলবে, আমি তো এই রুমের কাউকেই কিছু বলি নি! কোন একটা সিরিয়াস বিষয় হয়ত ছিল, ভাই তো রেগে আগুন হয়ে গেলেন। পুরো রুমকে ডেকে পাঠালেন ১৬ নম্বর রুমে। রাফসান রুমে এসে ভীত গলায় বলল, কীরে, রুম থেকে বের হওয়া নিষেধ ছিল নাকি! আমার এবার সব মনে পড়ল! কী আর করা ওই রুমের চারজনসহ আমি ব্লক লীডারের রুম থেকে কঠিন রকমের মার খেয়ে আসলাম! ক্যাডেট কলেজগুলোতে গ্রুপ পানিশমেন্ট তেমন কোন ব্যাপার না। কিন্তু এরকম একজনের জন্য অন্যজনের ইনডিভিজুয়াল পানিশমেন্ট বিষয়টা একটু কেমন যেন। আমার খুব খারাপ লাগল, আমার জন্য বেচারা নির্দোষ ছেলেগুলো মার খেল। এই চারজন তখন খুব স্বাভাবিকভাবে বিষয়টা মেনে নিল, এমনকি আমাকে একবার দোষারোপ পর্যন্ত করল না!


ক্লাস নাইন ছিল রাফসানের টার্নিং পয়েন্ট। সেভেনে অতি ভদ্র, এইটে মধ্যম শ্রেণির রাফসান এবার হয়ে উঠলো পুরোপুরি একটা সন্ত্রাসী! হাউজে এমন কোন অপরাধ হয় না, যেখানে রাফসান থাকে না। আমরা যখন নাইনে, তখন আমাদের কলেজে রিইউনিয়ন হল। নিচতলার হাউজে এক্সক্যাডেট থাকবেন বিধায় আমরা চলে গেলাম ওপরের হাউজগুলোতে। চারদিন পর ফিরে আসার পনের মিনিট পরেই শুনলাম, রুম থেকে বের হওয়া নাকি নিষেধ! এটা আমাদের কলেজের খুব প্রচলিত একটা নিয়ম, বিশেষ করে যখন, সিনিয়র ক্লাসের যখন টিটিরুম বা টানেলে ডাক পড়ে, তখন জুনিয়র ক্লাসদের রুম থেকে বের হওয়া মানা। আমরা সাধারণভাবেই মেনে নিলাম। সেভেন থেকে নাইন পুরো হাউজ রুমের ভিতরে, বাইরে কী হচ্ছে কেউ জানে না! কেউ প্রকৃতির ডাক উপেক্ষা করে, কেউ বাথরুমে সাবানমাখা গায়ে অপেক্ষা করে বসে আছে। এই অবস্থায় রাফসানদের রুম থেকে খুব হাসিতামাশা শোনা গেল। আধঘণ্টা নাগাদ, পরিবেশ স্বাভাবিক হল, সবাই রুম থেকে বের হল। পরে দেখা গেল, ১২৪ নম্বর রুমের সামনের ডাস্টবিনে বিরিয়ানির প্যাকেট!

পরে জানা গেল, এই রুমে এক্সক্যাডেটরা বিরিয়ানি রেখে গিয়েছিলেন। এই সময়ে কেউ যেন সেখানে ভাগ বসাতে না পারে, এজন্য রাফসানসহ এই রুমের চারজন পাপী বাকি সবাইকে বলে গেছে, ভাইয়ারা সবাইকে বের হতে নিষেধ করেছে! পৃথিবীতে আজকাল কোথাও সুবিচার হয় না। এই মহাপাপেরও কোন বিচার হল না। আমরা বাকিরা সবাই ডাস্টবিনে পড়ে থাকা প্যাকেট দেখে হাহুতাশ করলাম। ক্লাস নাইনে আমি আর রাফসান পাশাপাশি রুমে ছিলাম। আমরা দুই রুম যে কী কী করে বেড়াতাম, এখনো মনে পড়লে হাসি পায়, “সুখের মত ব্যথা” অনুভূত হয়। কী সুন্দর ছিল আমাদের দিন!

এইট-নাইনে রাফসানের সাথে একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে আমার বেশ প্রতিযোগিতা চলত। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক ম্যাচ থেকে আমি অবসর নেয়ায় সে জায়গাটা
Nafis
দখল করে নেয়। তবে এখন শুনলাম, নাফিসের ফর্ম এখনো পড়ে নি। কিন্তু রাফসানের সারাদিন ড্রেনে গড়াগড়ি করে আর মুড আসে না!

ক্লাস টেনের শুরুতে রুম নিয়ে একটা বিশ্রী কাণ্ড হয়ে গেল। এই ঘটনার জন্য আমি কাউকে দোষ দিই না। আর পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুব বেশি নাড়াচাড়াও করি নি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিষয়টা মোটেও ভাল ছিল না এবং আমাদের সবারই প্রচন্ড রকম দোষ ছিল। সময়ের সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। আমরা সবাই স্বাভাবিক হয়ে গেলাম, ব্লক পেলাম না এবং যে যার রুমে সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকলাম! ধীরে ধীরে এসএসসি পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এল। এরকম সময়ে খুব খারাপ একটা ব্যাপার ঘটে গেল।

রাফসানের বাবা অসুস্থ ছিলেন। টেস্ট পরীক্ষার এক দিন আগে গেমস টাইমে রাফসানকে লীভে পাঠানো হল। আমরা কেউ কিছু জানতাম না, রাফসানও সম্ভবত জানতো না। এরকম একটা সময়ে তিনি মারা গেলেন। স্রষ্টা তাঁকে পরপারে সুখী করুন।
আমি জানি না, এটা এখানে উল্লেখ করে তোর মনটা খারাপ করে দিলাম কিনা, কিন্তু আমার মনে হল তোকে নিয়ে আমার জানা সবকিছুই থাকুক এখানে। মাঝে মাঝে চোখের জল ফেললে মন ভাল থাকে। বাবা-মায়ের জন্য কাঁদলে স্রষ্টা খুশি হন।

চার-পাঁচদিন পর রাফসান ফিরে এলো। এরকম একটা কঠিন সময়ে রাফসান কীভাবে সবকিছু ঠিক করে আমাদের সাথে স্বাভাবিক হয়ে গেল এবং এসএসসিতে অসাধারণ একটা রেজাল্ট করে ফেললো, ভাবলে আমার শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। এমনিতে আমি কখনো কারও ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাটি করি না, কিন্তু আমার একটা বাজে অভ্যাস ছিল, চোখের সামনে কারও ডায়েরি দেখলে আমি চুপচাপ পড়ে ফেলতাম। ইলেভেনে রাফসানের ডায়েরিতে আমি পড়লাম, “আজ আপুর রেজাল্ট দিল। এই রেজাল্ট বাবা দেখলে বড় খুশি হতেন।" রাফসান খুব হাসিখুশি মানুষ, কিন্তু ভেতরে যে রাফসান একজন অত্যন্ত সংগ্রামী মানুষ, সেদিন বুঝেছিলাম।


আমরা ইলেভেনে উঠে গেলাম। রক্ত গরম ইলেভেন! হাউজের নানান কাজ, আমি খোঁজখবরও রাখি না। ক্যাডের সময় শুকনো মুখে সবার পিছনে বসে রুবিক্সকিউব ঘোরাই, ম্যাথ অলিম্পিয়াডের প্র্যাকটিসে লাইব্রেরিতে গিয়ে গল্পের বই পড়ি। বাকি সময় টিভিরুমে বসে বিরসবদনে আবেদনময়ী ললনার গানবাজনা শুনি। সুন্দর দিন যাচ্ছিল। হঠাৎ করে একদিন ফর্ম থেকে প্রিন্সিপাল অফিসে আমার আর রাফসানের ডাক পড়ল। আমার বন্ধুরা জানে এই কয়েকদিন কী ছিল! তার চেয়েও বেশি জানে রাফসান! আমি এখনো কোন কাজকর্ম করি না। অডিটোরিয়ামে ফাংশন হলে
আরেফিন
এর সাথে গিয়ে বিতর্কের ঘণ্টা বাজাই, কোন ক্লাসকে হাউজের পিছনে ফলইন করালে “দিল কি দয়া হয় না” গাই। আর নিয়ম করে ড্রায়িং রুমে সবার সাথে ধাক্কাধাক্কি করি সবার আগে না দাঁড়ানোর জন্য। কোন দায়িত্ব পড়লে সবার আগে
Naim
এর কাছে ছুটে যাই, ভাই কাজটা করে দে। হাউজের কাজ হলে রাফসান করে দেয়। এই বিষয়ে আমার আর কিছু মনে নাই। কিন্তু রাফসান না থাকলে এই সময়ে আমি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতাম।

কোন এক বিশেষ দিনে ফজরের নামাজ হবে, সবাই নেমে গেছে, টুয়েলভের ভাইয়েরাও নামার জন্য তাড়াহুড়ো করছে। আমি আর রাফসান তখনো ঘুমে, জুনিয়র এসে কয়েকবার ডেকে গেছে, ঘুমের ঘোরে কী বলেছি, মনে নেই। পুরো ককেজ মসজিদে, জাহাঙ্গীর হাউজের কেউ নামে নাই। এরকম অসংখ্য কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যাপার করেছি, রাফসানেরা সব সামাল দিত। আমি রাফসানের কাছে এসব কারণে বিপুলভাবে কৃতজ্ঞ।

খারাপ সময়ের কথা যতটা পারা যায় কম মনে করাই ভাল। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় আমার কাছে খুব খারাপ লেগেছে। ক্লাস টুয়েলভের শুরুর দিকেও এরকম কিছু ব্যাপার ঘটেছে। কিন্তু পরে এই বিষয়গুলো নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করেছি, এবং পরে মনে হয়েছে, সবার জায়গা থেকে আসলে সবার কথারই যুক্তি আছে। যাহোক, আমরা টুয়েলভে উঠে গেলাম। হাউজের রুম ক্রিকেট থেকে শুরু করে গ্রাউন্ডে কাঁঠাল পাড়া যাবতীয় কাজে তোর সরব উপস্থিতি। ফর্মে বাঁশের প্রচলন, যেটা আমি প্রায় সব লেখাতেই বলি, কারণ বিষয়টা আমার কাছে খুব অভিনব মনে হয়েছে। কিছু হোক না হোক, রাফসানের নামে একটা গণ ইস্যু হতো।

ডাইনিং এ মাঝে মাঝে হাত দিয়ে খাওয়া হত। যেদিন গরু দিত, হাতে সব তেলচর্বি লেগে থাকত। ওই অবস্থায় ফর্মে এসে ওয়াশরুমে সাবান এবং সাবানজাতীয় যা কিছু হাতের কাছে থাকত, তাই দিয়ে হাত ধোয়া হতো। রাফসানের সব কাজে একটু আধটু পোংটামি না করলে ভাল লাগে না। রাফসান সিদ্ধান্ত নিলো শ্যাম্পুর প্যাকেটে শ্যাম্পুসদৃশ এক জাতীয় পিচ্ছিল পদার্থ (জ্ঞানী পাঠকমাত্রই এটি অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন!) বেসিনে রেখে আসবে। সেদিন সবার আগে ডাইনিং থেকে এসে ওয়াশরুমে রাফসান হাজির। কে সেই শ্যাম্পুর প্যাকেটের সদ্ব্যবহার করে তাই দেখা হবে। আমাদেরই এক বান্দাকে দেখা গেল, শ্যাম্পুর প্যাকেট দেখে প্রবল উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে! গরুর তেলচর্বিমাখা হাতে এই মহামূল্যবান বস্তু কিছুক্ষণ অতি উৎসাহে ঘষাঘষি করার পর রাফসানের হাসির চোটে আর ফেনার উল্লেখযোগ্য রকমের স্বল্পতা দেখে এই বস্তু যে শ্যাম্পুর মোড়কে অসংখ্য ছোট ছোট বাচ্চা, এই কথা আন্দাজ করা গেল!

নাইন ডে'জ এক্সকার্শন (বাঁ থেকে - ইশতিয়াক, আখতার, রাফসান)

রাফসানের নাম মনে হলেই দুটো ঘটনা সবার আগে মনে পড়ে। মাহমুদ স্যার ভিজিটর্স ডেস্কে বসে আছেন। এই সময় Soikot এর মাথায় গুঁড়াকৃমি নড়াচড়া শুরু করে দিল। রাফসানকে ডেয়ার দেয়া হল, স্যারের কাছে গিয়ে বলতে হবে, “স্যার, মুততে যাবো!” ডেয়ার পেলে রাফসান কখনো দুইবার ভাবে না। বীরদর্পে স্যারের কাছে গিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বলল, “স্যার, মুততে যাবো।“ স্যার রীতিমত আকাশ থেকে পড়লেন, এই ছেলে কী বলে! পরে স্যারকে অনেক কষ্টে ব্যাপারটা বোঝানো হল এভাবে, আসলে রাফসান গ্রামের ছেলে, এভাবেই কথা বলে। আমরাও নাকি ওকে এসব শুধরে দিই, কিন্তু অভ্যাসবশত আবার বলে ফেলেছে! পরবর্তীতে, এই ডেয়ারের পুডিং নিয়ে অনেক রাজনীতির পর সিদ্ধান্ত হল, এই ডেয়ার রফসান পুরোপুরি কমপ্লিট করে নি, তাই যৌক্তিকভাবে রাফসান কোন পুডিং পাবে না।

আরেকটা ঘটনাও ডেয়ার সম্পর্কিত। কোন ছুটির দিনের পর ফর্মের জানালার পাশে একটা আধগলা মরা টিকটিকি পাওয়া গেল। কথায় কথায় বেয়ার গ্রিলসের কথা উঠলো, কে যেন বলে উঠল, এই টিকটিকি খেতে পারলে পুডিং। এটা কোন যুক্তিসঙ্গত বাজি হলো না, কয়েকদিন আগের মরা একটা আধপচা টিকটিকি কেউ খাবে না। রাফসান গেল এই বাজিকে যুক্তিসঙ্গত করতে। ঠিক হলো লেজ ধরে এই টিকটিকি মুখের ভেতর নিতে হবে, খাওয়ার দরকার নাই। রাফসান আবারো রাজি হয়ে গেল। আমরা সবাই মোটামুটি নিশ্চিত, এই টিকটিকির লেজ ধরে মুখের সামনে নিলেই লেজ খসে এই টিকটিকি টুপ করে রাফসানের মুখে পড়ে যাবে। অবশেষে সব ভুল প্রমাণ করে রাফসান সত্যি সত্যি এই টিকটিকি ইয়া বড় হা করে মুখের সামনে নিল। ভাগ্যিস টিকটিকি সত্যিই সেখান থেকে লাফিয়ে রাফসানের মুখে আত্মাহুতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নি। আমার যতদূর মনে পড়ে এবারের সবগুলো পুডিং রাফসান বুঝে পেয়েছিল।

রাফসানের গুণের কথা বলে আমি এজীবনে শেষ করতে পারব না। লেখাপড়া খেলাধুলা সবজায়গায় রাফসান ছিল অনন্য। এমনকি ছয়বছরে দুয়েকবার ১০০ মিটার স্প্রিন্টে রাফসান একজনকে পেছনে ফেলে পঞ্চমও হয়েছিল! না, আসলেও রাফসান ভাল অ্যাথলেট ছিল, শুধু স্প্রিন্টেই একটু খারাপ করত আরকি! হার্ডলে রাফসান ছিল অপ্রতিরোধ্য, ফুটবল, ভলিবল, বাস্কেটবল সব খেলায় ছিল অসাধারণ। ক্রিকেটের প্রতি এতই অনুরাগ ছিল, যে ফর্মেও হেড টেল খেলার প্রচলন করেছিল! হাউজের প্রতিটি কাজে রাফসানের মত স্বতঃস্ফূর্ত আর ডেডিকেটেড মানুষ সচরাচর দেখা যায় না।


আসলে রাফসান এত হাসিখুশি একটা মানুষ, সবসময় আশেপাশের মানুষদের নিয়ে আমোদফূর্তিতে মেতে থাকতো। একসাথে বেঁচে থাকা সেই রংবেরঙের হাসিকান্নার গল্পগুলোই আমাদের দুঃখ পেতে দেয় না। আমাদের প্রতিটা মুহূর্তই একেকটা গল্প। সব গল্প বলা সম্ভব না, কিন্তু মনের কোণে সব গল্পই রয়ে যায়।
রাফসান, তুই যে আমার কতটা কাছের মানুষ ছিলি, তোকে আমি কি ভীষণ পছন্দ করি, সেটা সম্ভবত তুই কখনো চিন্তাও করতে পারবি না। তুই, তোর পরিবার সকলের জন্য শুভকামনা।

কৃষ্ণকলির একটা গান আছে আমার খুব পছন্দের –

“বন্ধু আমার মন ভাল নেই, তোমার কী মন ভাল?
বন্ধু তুমি একটু হেসো, একটু কথা বলো।
বন্ধু তোমার বন্ধু আমি, বন্ধু মোরা কজন
তবুও বন্ধু ভাসি নাকো, আঁকি নাতো স্বপন।”

React

Share with your friends!

Comments