Recent Posts

বন্ধু গো, আজ তোমায় বড় বেশি প্রয়োজন (১৯০১)



ছোটবেলায় আমি তেমন গালিগালাজ জানতাম না। এক ইঁচড়েপাকা বন্ধুর বদৌলতে মানুষের পশ্চাদ্দেশের একটা সুন্দর বাংলা শব্দ শিখলাম। তখন বোধহয় কেজি কি ওয়ানে পড়ি। ক্লাসে গিয়ে নিজের এই বিদ্যা সবার সামনে জাহির করলাম। ভাল জিনিস মানুষের পছন্দ হয় না। এক অতি উৎসাহী বন্ধু স্বপ্রণোদিত হয়ে ম্যাডামকে বলে দিল। বিদ্যাদানের অপরাধে আমার বরাতে জুটলো ক্লাসের বাইরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। বন্ধু এখানেই থামলো না, এই খবর বাড়ি বয়ে দিয়ে গেল। সুতরাং বাড়িতেও বেশ একদফা মারধোরের সম্মুখীন হতে হলো।

এরপর অনেকদিন কেটে গেল। ক্যাডেট কলেজে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে এক বন্ধুর দেখা মিললো, যার নামই হয়ে গেলো আমার শৈশবে শেখা সেই অমূল্য বিদ্যার ধন। তার সমগ্র শরীর ছাপিয়ে কেবল দুটি অংশই “অক্ষির সম্মুখে বিদ্যমান”! হাঁটলে কিংবা দৌড়ালে মনে হয় “পাছা”র আকৃতির দুটি ফুটবল গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেই বন্ধু যেকোন সময় সামনে আসলেই সজ্ঞানে-অজ্ঞানে কেবল একটি শব্দই মনের কোণে ভেসে ওঠে।

আমার সেই বন্ধুটির নাম হামীম।

ক্লাস সেভেনে আমি অতি নিরীহ ছিলাম। মাঝে মাঝে ১০৮ নম্বর রুমে যাই, গিয়ে দেখি তিনটি জীব তিন আকৃতির। একজন কাঠির মত শুকনা, আকারে ছোটখাট। আরেকজন লম্বাচওড়া। আরেকজন ছিল গোলগাল, মুখে হাসি (দেখে মনে হত একটা আস্ত জোকার, পরে যখন জোকস শুনলাম, তখন বুঝলাম কী ভয়ঙ্কর এই জোকার!), চোখ প্রায় সবসময় অর্ধেক বন্ধ – এককথায় একটা বড়সড় গোলআলু। আমাদের আজকের বিষয়বস্তু এই তৃতীয় প্রাণীটি।

নভিসেস ড্রিলের প্র্যাকটিস। হামীমের সুললিত গলা, জোরও আছে গলায়। কমান্ডার বানানো হল হামীমকে। হামীম ড্রিল করে পারমিশন নিতে যায়, আর উজ্জ্বল স্টাফ হায় হায় করে। এমন গাট্টাগোট্টা শরীর, ঠ্যাঙের তলে এত গোশত (চর্বি না, পুরোপুরি শক্ত গোশত), ঠিকঠাকমত নাকি হাইট হয় না। সুযোগ বুঝে স্টাফ আবার শক্ত ঠ্যাঙের উপরিভাগ দলাইমলাই করে, কী একটা অবস্থা! এভাবে চলতে পারে না, কমান্ডার হল হামীমের রুমমেট ইফাজ। গলা ঠিক রাখার জন্য হামীমের কপালে রাতে গরম চা মিলত, সব বন্ধ হলো। লোকমুখে শোনা যায়, হামীমের চোখের পানিতে নিচতলার হাউজে প্রায় বন্যার মত একটা অবস্থা।

কিছুদিন পর ১০৮ এ নতুন করে উঠে পড়লাম আমি। আমি হামীম আর আশহাব। ঝামেলাবিহীন সুন্দর দিন যাচ্ছিল। সমস্যা একটাই, আমরা কেউই ঘুম থেকে উঠতে পারি না। একেকদিন এমনও হয় সকালে পিটি শুরু হয়ে গেছে, আমরা তিনজন ঘুমাচ্ছি; মতিয়ার ভাই এসে ডাকাডাকি করছে! এরকম একদিনের ঘটনা। শীতের দিন, সকালে কুয়াশা বেশ ভালমত জাঁকিয়ে বসেছে। কম্বলের তলায় আমরা তিনজনই আরামে ঘুমাচ্ছি। পিটি প্রায় শুরু হয়ে গেছে। এসময় দেখা গেল আমরা তিন বান্দা ফলইনে নাই। মহানুভব ফাইয়াজ ভাই সেসময়কার জেপি। তিনি আমাদের দুয়েকটা শাউট দিয়ে আর কিছুই বললেন না। কিন্তু আমাদের পাশের রুমের নির্দোষ ছেলেগুলো কেন আমাদের ডাকে নি, সেই অপরাধে কঠিন রকমের শাস্তি দিলেন। এই বিচার আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমরা তো স্বপ্ন দেখছিলাম, আমাদের কোন দোষ হয় নি। স্বপ্ন না দেখেই বেচারা ১০৯ নম্বর রুম দোষ করে ফেলেছে, কী বিচ্ছিরি ব্যাপার!

একদিন হঠাৎ করে দেখি রাতে হামীম রুমে নাই। পরে জানলাম, ওয়াল ম্যাগাজিন আসছে, সেখানে হামীম গেছে ছবি আঁকতে। কয়েকদিন পর আমারও ডাক পড়লো, আমি কিছু পারি না। ঘুম ঘুম চোখে মানুষজনের কাজকর্ম দেখি। হক ভাইয়ের একেকটা ছবি দেখে হা হয়ে যাই, হামীম তখনও বাচ্চা। তেমন একটা আঁকাআঁকি করে না। কিছুদিন পরে দেখি ওয়াল ম্যাগাজিনের অর্ধেক ছবিই হামীমের (সময়ের সাথে সেটা আরও বেড়েছে)। শেখ মুজিবের একটা স্কেচ করেই একবার আমাদের ওয়াল ম্যাগাজিন চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে দিল! হামীমের গুণের শেষ নাই, সব এখন বলবো না। প্রসঙ্গক্রমে একটা বলা যায়। হামীম খুব সুন্দর গান গায়। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য হামীমের নাম আসলো। এদিকে তার আগের রাত ওয়াল ম্যাগাজিনের শেষ রাত, পুরো রাত জেগে থাকতে হয়েছে। আমি ব্রেকফাস্টে গিয়ে ব্রেডে বাটার লাগাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। হামীম আমার টেবিলমেট ছিল, তার সে কী হাসি! কথায় বলে হাসির পরে আসে কান্না। ব্রেকফাস্টের পর হামীম গেল মঞ্চে গান গাইতে। হঠাৎ করে দেখি মাইক থেকে একটা বেসুরো আওয়াজ আসছে, পরে দেখি গান গাইতে গাইতেই বেচারা হামীম ঘুমিয়ে পড়েছে!

   
লেখকের অগোছালো বিছানায় একবার বসেছিল হামীম

ক্লাস সেভেনের আরেকটা ঘটনা দেয়া যায়। এই ঘটনাটি সত্য নয়, তবে প্রচলিত। মসজিদে সবাই নামাজ পড়ছে, এই সময় কোন একজনের হাতের চাপ লেগে হামীমের পাঞ্জাবির সেলাই খুলে একরকম শব্দ হলো। পেছনে তখনকার টুয়েলভের ভাইয়েরা। তারা এই শব্দকে মজা করে বানিয়ে দিলেন অন্য একটা শব্দ। পুরো কলেজ রটে গেল, ক্লাস সেভেনের একটা বাচ্চা হাতি নামাজের মধ্যে ওজু ভঙ্গের একটা কারণ ঘটিয়ে ফেলেছে। হামীমের নাম হয়ে গেল “বুম বুম ঠুস ঠুস”! হামীমের নামে আরেকবার অপবাদ দেয়া হয়েছিলো। ফর্ম চেঞ্জের সময় ভুল বোঝাবুঝির কারণে এক মহাপণ্ডিত পুরো ডিসপ্লে বোর্ড ছিঁড়ে নিয়ে চলে এসেছে। আসল ব্যক্তি ধরা পড়ার আগে কীভাবে যেন হামীমের নাম চলে এলো। হামীম আবার কান্নাকাটি করে নিচের হাউজে বন্যা বাঁধিয়ে দিলো।

কুড়িগ্রামের বন্যা এক্সপার্ট মাহফুজ এগিয়ে এলো। ক্লাস এইটে হামীমের রুমমেট হলো এই দৈত্যাকার মাহফুজ, এবং দ্বিতীয়বারের মত আমি। রুমে যে কীসব কিম্ভূত জিনিসপত্র হতো! মাহফুজ দেখতে ছিল দৈত্যের মতো, কিন্তু কাজকর্ম করতো বাচ্চাদের মতো, এক আঙুল বের করে কাঁইকুঁই করতো! এক টার্মেন্ডের রাতে কারো চোখে ঘুম নেই। একগাদা ঝালমুড়ি কিনে খাওয়া হয়েছে। এবার মাহফুজ মাসল দেখানো শুরু করলো, কলমদানির পাছা ফেলে দিয়ে তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিল (কী অশ্লীল ব্যাপার!)। এমন মাসল ফুলিয়ে দেখালো, যে কলমদানি পর্যন্ত ভেঙে গেল! বিনা পয়সায় এমন সার্কাস দেখে আমরা চেঁচামচি শুরু করলাম। সেই চেঁচামেচি শুনে জেপি চলে এলেন। সামান্য পানিশমেন্ট দিয়ে কিছু অমর ডায়ালগ দিয়ে চলে গেলেন। বন্যা এক্সপার্ট মাহফুজ সেই ডায়ালগ শুনে খিকখিক করে হাসতে থাকলো। আমাদের সুখদুঃখের দিনগুলো এগুতে থাকলো। জেএসসির সময় এই মাহফুজ ১১০ নম্বর রুমকে সরাইখানা ঘোষণা করলো।

আমরা ক্লাস নাইনে উঠে গেলাম। নাইনে হামীম গেল আমাদের পাশের রুমে। যা মনে আসে তাই করি, কী কী করতাম ভাবলে এখন হাসি পায়। সুখের দিনগুলি চিরস্থায়ী হয় না।

একদিন দেখি গেমস টাইমে কী একটা বিষয় নিয়ে মারামারি করে হামীম আর সিগবাদ একজন আরেকজনের গেমস টিশার্ট ছিঁড়ে ফেলেছে। পরে আবার দেখি হাউজে এসে এই দুইজন খুব স্বাভাবিকভাবে হাসিতামাশা করছে, কিছুই হয় নি! আস্তে আস্তে হামীমের ভয়ঙ্কর জোকস বলার অভ্যাস শুরু হলো। আমি এই বিষয়টা খুবই অপছন্দ করি। পরিস্থিতি এমন হলো, যেকোন বিষয়ের ওপর হামীম যেকোন সময় তাৎক্ষণিকভাবে একটা জোক পয়দা করে ফেলছে! আমি হামীমকে খুব ভয় পেতে শুরু করলাম।

কিন্তু বিধি বাম। এসএসসির লম্বা ছুটি কাটিয়ে হাউজে ফিরলাম। নোটিশবোর্ডে দেখি আমার রুমমেট হামীম! আরেকজন আমার চিরশত্রু, হামীমের বেস্ট ফ্রেন্ড ফিরদৌস। এইসময় একটা বিপত্তি ঘটলো। এসএসসি পরীক্ষার পর ছেলেপেলে সব কলেজে উঠে গেছে, একটা বাতাস লেগেছে গায়ে। “হাওয়া মে উড়তা যায়ে” টাইপ একটা ব্যাপার। সেই বাতাসে হামীমের ভারি শরীরও দুলে উঠলো! হামীম নারীর মোহে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। হামীমের কান্নাকাটি থামাতে মাহফুজ বন্যা এক্সপার্ট হয়ে এগিয়ে এসেছিল, সেটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ মাহফুজ কুড়িগ্রামের ছেলে! এখন আবার হামীমের প্রেমগুরু হয়ে আবির্ভাব ঘটলো নতুন এক মাহফুজের!

   
হলুদ টিশার্টের এই ছেলেটিই হামীমের প্রেমগুরু মাহফুজ

মাহফুজ ছেলেটা এমনিতে ভাল। কিন্তু “অল্প বয়সে পিরিত করে” একটু বখে গেছে। আমরা ছোটবেলায় সেই প্রেমের গল্প হা হয়ে শুনতাম, মাহফুজের ক্রিপ্টোলজির ডায়েরির লেখা উদ্ধার করতাম। কাজেই মাহফুজের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল হামীমের প্রেমগুরু হওয়ার ব্যাপারে। দেখা গেল সারাদিনের ক্লান্তিকর ক্লাস করে লাঞ্চের পর বিছানায় একটু শরীরটা একটু ঠেকিয়েছি, কিংবা প্রেপের পর টিভিরুমের “সুপার গার্ল ফ্রম চায়না” (তখন এটা একটা হিট গান ছিল!) শুনে এসে একটা হেভি মুডে আছি! ওমনি হামীম শুরু করে দিলো, “দোস্ত শোন, তারপর হলো কী! …..”

এই গল্প আমরা কমপক্ষে কয়েকশ বার শুনে বসে আছি। প্রথমদিকে আমরা একটু আগ্রহের ভান করে শুনতাম, হাজার হোক, ছেলেটা নতুন প্রেমে পড়েছে। পরে যে অবস্থা দেখলাম, তাতে আর আগ্রহের অভিনয় করারও জো ছিল না। এর মধ্যে আবার কী সব ডায়েরি লেখে, মানে একটা যা তা অবস্থা। নারীর মোহ বড় কঠিন জিনিস, তখন বুঝেছিলাম। আস্তে আস্তে এই গল্পের শ্রোতা কমতে কমতে একজনে গিয়ে ঠেকল। কেবল মাহফুজকেই দেখি পরম আগ্রহে প্রায় মুখস্থ হয়ে যাওয়া সেই গল্প বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে শুনছে। এই গল্পের আভাস পেলেই আমরা রুম থেকে একেকটা অজুহাত দেখিয়ে চলে যেতাম। অসহায় হামীম তখন পাশের রুমে মাহফুজের আশ্রয়ে চলে যেত। তখন আবার মাহফুজের রুমমেটরা, বিশেষ করে মুনতাসিন আমাদের রুমে চলে আসতো! মাহফুজের এই অসীম ধৈর্যের জন্য আমি খুব শ্রদ্ধা করি।

এই সমস্যাটা বাদ দিয়ে ইলেভেনে আমাদের জীবন খারাপ ছিল না। ক্যাডের সময় হামীম টিটিরুমে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, আমি গিয়ে কাজের ডিস্টার্ব করি। হামীম কিছু বলে না। এরপর আমার স্থান হয় টিভিরুমে। সবার পেছনে বসে শুকনো মুখে ক্যাডের সীন দেখি, আর হাহুতাশ করি।

ইলেভেনের এক্সকারশনে আমরা সবাই খুব মজা করছি। হঠাৎ করে দেখা গেল হামীমের গায়ে লাল লাল কী একটা উঠেছে। আস্তে আস্তে হামীমের সারা গায়ে পক্স উঠলো। মির্জাপুরের হাসপাতালে হামীমকে রেখে আমরা গেলাম ফ্যান্টাসি কিংডমে। হামীম বুকভরা বেদনা কিন্তু মুখে হাসি নিয়ে বললো, “আমি তো আগে গিয়েছিলাম।” সেই হাসিতে যে কী গভীর বেদনা, আঙ্গুর ফল কেন, পারলে রসমালাইও টক হয়ে যায়।

ইলিয়াস স্যার তখন হাউজ মাস্টার। সায়ীদ স্যার হাউজ ডিউটিতে। আমাদের ফোন করার ডেট। সবার কথা বলা হয়ে যায়, হামীমের কথা শেষ হয় না। ফোন সবসময় কানে ধরা, তাও না। একেকবার একেক ভঙ্গিতে পর্দার আড়াল থেকে হামীম কী যেন করে। স্যারের নজরে এলো। পরে দেখা গেল কপোত-কপোতীর মেসেজ। আহা, কী মধুর দৃশ্য! একটা করে মেসেজ স্যার পড়েন, আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। আমরা কেউ জানতে পারলাম না কী মেসেজ ছিল। সব জানলেন ইলিয়াস স্যার। তিনিও খোলা মনের মানুষ। খেলা জমে উঠলো। বেচারা হামীম!

আমার এখনো মনে পড়ে, ইলেভেনের শেষের দিকে নতুন রুমের মীটিং আমাদের রুমে বসলো। কে কোন রুম পাবে মোটামুটি একটা ভাগ বাটোয়ারা হলো। ইলেভেনের জীবনটা বড় ভাল ছিল। এসব মনে হলে কী খারাপই না লাগে!

টুয়েলভে হামীম গেল ৩২ নম্বর রুমে, আমি ৩৫ এ। ফর্মে হামীম ফাহিমের সাথে পালা করে ভয়ঙ্কর জোকস বলে। আসমান থেকে মুরগির ভাজি আর গরুর ঝোল ফেললে নাকি মুরগিপাখির ভাজা আগে মাটিতে পড়বে। কারণ চিকেনফ্রাই হলো ফাস্ট ফুড! এসব শুনলে আর দিনদুনিয়া ভাল লাগে না, মনে হয় যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই। বেঁচে থাকার আগ্রহ পাই না। হঠাৎ করে যেদিন দেখি মডার্নে একটা ট্রাকের টায়ার ফেটে যায়, অমনি মনে হয় জীবনে রঙ এলো, বেঁচে থাকার আগ্রহ পাচ্ছি, জীবনের অর্থ খুঁজে পাচ্ছি! সবাই মিলে চলে যাই ৩২ নম্বর রুমে। অন্য হাউজের ছেলেরাও কেউ কেউ অতি উৎসাহে চলে আসে। বাকিরা ওপর তলা থেকেই জানান দেয়, তারাও শামিল হয়েছে এই মহোৎসবে। বুমবুম হামীমকে গিয়ে বলি, “ভাই, ঠিক আছিস? এত পাওয়ার কই থেকে পাচ্ছিস!”

খাকি জমিনে একবার একটা কিছু রটে গেলে আর রক্ষা নাই। হামীমটা কিছু না করেই টায়ার ফাটার দায়ভার নেয়। আর বিরসবদনে ভাবে, গোটা বাংলাদেশে এত ট্রাক চলে, আর সব টায়ার ফাটতে হয় এই মডার্নেই। হায়রে জীবন, কোথাও এতটুকু সুবিচার নাই!

ভাবতে ভাবতে হামীমের মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে যায়। আমি তখন প্রবল প্রতাপে মানুষজনকে পড়া বুঝিয়ে দিই। আসলে খারাপ ছাত্র, কিন্তু এমন একটা ভাব ধরে থাকি, যেন বিদ্যাসাগর! এক পাপী মাহমুদ ছাড়া আমি বাকি সবাইকে কোন না কোন সময় কিছু না কিছু বুঝিয়ে দিয়েছি। দেখা গেল, প্রেপে গেলে আমি নিজে আর কিছু পড়তে পারি না। তাই ভাবলাম, আর ভাব ধরে থাকা চলে না, নিজে পড়াশোনা না করলে আসল জায়গায় ঠিকই ধরা খাবো। সবাইকে বলি “ভাই এখন না, পরে আসিস”। হামীমকেও ফিরিয়ে দিলাম। একদিন বেচারা রাগীব আসলো কী যেন একটা সমস্যা নিয়ে। ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের যে সমস্যা, সেটা ফেলে দেওয়ার মতো কিছু না। তার ওপর রাগীব আমার কাছে খুব একটা আসেও না, আসলে আসার দরকার পড়ে না! আর সমস্যাটা এমন না, যে আমি বুঝিয়ে দিব, সে চলে যাবে। দুজন মিলে কী একটা আলোচনা করছিলাম। এই সময় হামীমের সেই দুষ্টুবুদ্ধি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। আমি নাকি সবাইকে ফিরিয়ে দিই, রাগীব ছেলেটা দেখতে শুনতে একটু “চিকি”, বিধায় মজা নিচ্ছি। মন্দ কথা বাতাসের আগে ধায়, আমি জানার আগেই আমার নামে এই অপবাদ পুরো কলেজে রটিয়ে পড়লো।

হামীমের এরপর আর কিছু বুঝিয়ে নিতে আসার প্রয়োজন পড়ে নি, কারণ হামীম গ্রীন কার্ড পেয়ে চলে গেল আর্মিতে। আর আমরা কয়েকটা হতভাগা এসে যার যার মত পড়াশুনা শুরু করলাম। একটা কিছু করে খেতে হবে তো!

আইএসএসবি এর আগের ঘটনা। আমি তো জানি রেড কার্ডই পাবো, নাফিসও জানতো (যদিও পরে স্ক্রিনশট খেয়ে বিদায় নিয়েছে!)। আমাদের থেকে একজন বেশি ভালভাবে জানতো, ইনটেকের তেপ্পান্নজন গ্রীন পেলেও সেই একজন পাবে না। সুতরাং সেই ফিরদৌস সবাইকে নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করলো এডমিশন কোচিং করার সময় ঢাকায় থাকতে হবে, বাড়িভাড়া করতে হবে। সেখানে হামীমকেও নেওয়া হলো। সবকিছু ঠিকঠাক, এরকম সময়ে ব্যাটা সবুজ একটা কাগজ নিয়ে এসে বললো, “বিদায় বন্ধুরা, আমি যাচ্ছি স্বর্গপুরীতে, তোমরা ফার্মগেটের ধুলোতে বাসা খুঁজো!” আরে গরু, ফার্মগেটের অলিতে গলিতে যে স্বর্গের ঊর্বশী আমরা দেখলাম, সেই দৃশ্য কি তোমার ভাগ্যে আছে?

আমাদের ক্যাডেট জীবন শেষ করে যে যার রাস্তায় নেমে পড়লাম। একদিন তার স্বর্গপুরীতে যাওয়ার আগে আমাদের বাসায় পদধূলি দিয়ে গেল, সম্ভবত সে ঢাকায় এসেছিল জাঙ্গিয়া কিনতে। পরদিন এক বোতল কোকা কোলা খাওয়ালো। তারপর কতদিন এই বন্ধুর সাথে দেখা নাই। “যে যায়, সে চলে যায়, যারা থাকে তারাই জানে বাঁ হাতের উলটো পিঠে কান্না মুছে কী করে হাসি আনতে হয়।”

স্বর্গপুরীর সিঁড়িতে হামীম

হামীমের মত গুণী বন্ধু আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। এত সুন্দর ছবি আঁকে, এটা-ওটা বানায়, গান গায় এত ভাল! এখন আবার বাঁশি বাজাচ্ছে। খেলাধুলায়ও হামীম যথেষ্ট ভাল ছিল। একই সাথে শিল্পী, খেলোয়াড় আবার পড়াশুনা! সব একসাথে কীভাবে সম্ভব আমার মাথায় খেলে না।

মানুষ হিসেবে আমি অতটা ভাল না, তবে হামীম যতটা খারাপ মনে করে, তত খারাপও আমি না! আমাকে এত অপছন্দ করার কোন কারণ নাই। আমি কিন্তু তোকে খুব পছন্দ করি। আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি টীজ করেছি সম্ভবত হামীমকে। এরকম একটা বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমার খুব মনে পড়ে তোর কথা, সেই গাট্টাগোট্টা ছোট্ট হামীমের কথা, একটু বড় গোলগাল, রোদ পেলেই পটেটো ক্র্যাকার্সের প্যাকেটের মত ফুলে যাওয়া হামীমের কথা; আরও কত রকমের হামীমের কথা আমার স্মৃতিতে ব্যস্ত হয়ে ঘোরাফেরা করে!

তোর জন্য চিরকুটের একটা গান।

তুমি এসো ভালোবেসো

আমি তোমায় বেঁচে রই

বন্ধু গো আজ তোমায়

বড় বেশি প্রয়োজন

বন্ধু গো (চিরকুট)

React

Share with your friends!


Comments